গৌতম বুদ্ধ মানুষের ধর্ম বলতে কী বুঝিয়েছেন?

অথবা, মানুষের ধর্ম সম্পর্কে গৌতম বুদ্ধের মত সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, গৌতম বুদ্ধ মানুষের ধর্মের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা :
গৌতম বুদ্ধ ছিলেন মহান সাধক। তিনি মানুষের জীবনের দুঃখ-দুর্দশার হাত হতে চিরমুক্তি লাভের পথ আবিষ্কারের আশায় দীর্ঘদিন সাধনা করেছিলেন। পরে দীর্ঘ সাধনার দ্বারা তিনি সত্যের জ্ঞান লাভ করেন।
গৌতম বুদ্ধের বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে তাই বৌদ্ধদর্শন বা বৌদ্ধধর্ম নামে পরিচিত।
মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব : আজকের বিজ্ঞানের গতানুগতিক ধারণা অনুয়াযী, মানুষের ধর্ম হলো কতকগুলো অন্ধবিশ্বাস এবং অর্থহীন আচার-বিচার। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ মানুষের ধর্ম বলতে বুঝতেন মনুষ্যত্বকে।
মনুষ্যত্ব কথার অর্থ : মানুষকে তার যে বিশেষ গুণের জন্য অন্যান্য জীব থেকে পৃথক করা হয় তাই হলে মনুষ্যত্ব। এ গুণের কারণে মানুষ পশুর মত আচরণ করতে পারে না। তাই বুদ্ধ এ গুণের যথার্থ বিকাশের কথা বলেন।
মনুষ্যত্বের বিকাশ : বুদ্ধের মতে, যদি সমস্ত মানুষের মধ্যেই মনুষ্যত্ব সমানভাবে প্রথম থেকেই বিকশিত হতো, তবে মানুষে মানুষে গুণগত তফাৎ কখনই দেখা যেত না। মনুষ্যত্ব প্রথম থেকে কোন মানুষের মধ্যে সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয় না। কাজেই সদুপদেশের দ্বারা তার যথাযথ বিকাশ ঘটাতে হবে বলে বুদ্ধ মনে করেন।
মনুষ্যত্বের সাধনাই ধর্ম সাধনা : বুদ্ধদেবের মতে, প্রাত্যহিক জীবনের ক্ষুদ্র প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে সত্যানুসন্ধান, শিবসাধনা আর সত্যাকুলতার মধ্যে এক মহত্ত্বর ও বৃহত্তর জীবনের নামই মনুষ্যত্ব। শত সাধনায় ও প্রয়াসে এই মনুষ্যত্ব লাভ হয়। এই মনুষ্যত্বের সাধনার নামই ধর্মসাধনা।
যুক্তির নির্দেশে চলাই মানুষের ধর্ম : বুদ্ধের মতে, যুক্তির নির্দেশে পরিচালিত হওয়াই মানুষের মনুষ্যত্ব। যুক্তিতর্ক, বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা মানুষেরই আছে। মানুষের যুক্তি তাকে অসীমের সন্ধানে উন্মুখ করে তোলে। যুক্তি আছে বলেই মানুষ সীমার মধ্যে অসীমকে খোঁজে।
বৌদ্ধধর্ম মানুষের ধর্ম : বুদ্ধির মুক্তির কথা ঘোষণা করেই বৌদ্ধধর্মের জন্ম। বুদ্ধদেব মানুষের এই ধর্মের কথাই বলেছেন। বুদ্ধ বলেন, মোহ দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে বিচার করতে হবে ধর্মকে। তিনি বলেন, মোহেই বন্ধন, যুক্তিতেই মুক্তি। তাই বৌদ্ধধর্ম আসলে মানুষের ধর্ম ।
বুদ্ধদেবের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি : মোহমুক্তির উপায় নির্দেশ করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বলেন, সম্যক দৃষ্টিলাভ করতে হবে, যা যেমন তাকে ঠিক তেমনিভাবেই দেখতে হবে। চোখে মোহের অঞ্চন লাগলে চলবে না। এর নামই তো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। তাই বলা যায়, বুদ্ধদেব বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বোধ হয় প্রথম সমর্থক।
ধর্ম সাধনা হচ্ছে বিশেষ জীবনযাপন : বুদ্ধদেব ধর্ম বলতে কোন পূজা অর্চনা, উপাসনা বা বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান বুঝতেন না। তাঁর ধর্মে কোন অতীন্দ্রিয় ঈশ্বরের স্বীকৃতিও নেই। তাঁর মতে, নীতি নিষ্ঠ পবিত্র জীবনযাপনই মানুষের ধর্ম। তাই বুদ্ধদেব ধর্ম সাধনা বলতে এক বিশেষ রকম জীবনযাপনকেই বুঝতেন।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বুদ্ধদেব মানুষের ধর্ম বলতে মনুষ্যত্বকে বুঝিয়েছেন। চারিদিকে অন্যায়, লোভ, ক্ষমতা বিস্তারের উগ্র মোহ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে পীড়িত করেছে দেখে বুদ্ধ উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, কোন উচ্চতর আদর্শ মানুষকে আর অনুপ্রাণিত করে না। তাই মনুষ্যত্বের তথা মানুষের ধর্মের বড় প্রয়োজন বলে বুদ্ধ মনে করতেন।