অথবা, প্রতিবেদন কী? প্রতিবেদন লিখনের বিবেচ্য বিষয় এবং প্রচলিত রীতিনীতি আলোচনা কর।
অথবা, প্রতিবেদন লিখনের বিবেচ্য বিষয়, ধরন এবং প্রচলিত নিয়ম-কানুন আলোচনা কর।
অথবা, গবেষণা প্রতিবেদন লিখনের বিষয়বস্তু, প্রতিবেদনের ধরন এবং প্রতিবেদনের নিয়ম-
কানুন আলোচনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা : গবেষণা কাজের সর্বশেষ অথচ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল গবেষণার প্রতিবেদন লিখন। কোন গবেষণার প্রতিবেদন না লেখা পর্যন্ত গবেষণা প্রক্রিয়াটি অসম্পূর্ণ থাকে। যে কোন বিষয়ে গবেষণার মৌল উদ্দেশ্য হল নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন ও আদান-প্রদান। জ্ঞানের আদান-প্রদানের জন্য প্রয়োজন গবেষণার প্রতিবেদন লিখন। একটি গবেষণার কৃতিত্ব অথবা ব্যর্থতা গবেষণা প্রতিবেদন কতটা সুচারুরূপে প্রণয়ন করা হল তার উপরই বহুলাংশে নির্ভর করে। গবেষণা কাজে গবেষক হয়তো পরিচালিত কোন তাত্ত্বিক গবেষণার কাঠামো প্রণয়ন, বাস্তবধর্মী ও যৌক্তিক অনুকল্প যাচাই, সতর্ক নমুনা কাঠামো প্রস্তুত অথবা অসাধারণ কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু এগুলোকে যথাযথ প্রতিবেদন আকারে উপস্থাপন করতে না পারলে এদের তেমন কোন গুরুত্বই থাকে না।
গবেষণা প্রতিবেদন : প্রতিবেদন হল গবেষণার চূড়ান্ত ফল, গবেষকের চরম লক্ষ্য এবং গবেষক ও পাঠকের মধ্যকার যোগাযোগের মাধ্যম বা সেতুবন্ধন। একটি গবেষণার ফলাফল যত মূল্যবানই হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট গবেষক ছাড়া অন্য কেউ তা জানতে না পারলে কেউ এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না এবং জ্ঞানের প্রসারও ঘটে না। ফলে গবেষণার উদ্দেশ্য বহুলাংশে ব্যাহত হয়। এ সম্বন্ধে গুড এবং হ্যাট (Goode and Hatt) বলেছেন, “প্রতিবেদন হচ্ছে গবেষণার সর্বশেষ ধাপ এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা গবেষণার সম্পূর্ণ ফলাফল এবং সিদ্ধান্তসমূহ জানতে আগ্রহী তাদের কাছে এগুলো বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা, যাতে তারা এগুলো ভাল করে বুঝতে পারে।”
সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখে সরজমিনে অনুসন্ধানের পর সংগৃহীত তথ্যাবলির সুসংক্ষিপ্ত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ উপস্থাপনই গবেষণা প্রতিবেদন। সুতরাং, গবেষণা প্রতিবেদন হল: “A formal statements of the result of an investigation
or of any matter on which difinite information is required made by some person or body, instructed on requied to do so.”
তাই লক্ষ করা যায় যে, গবেষণা প্রতিবেদন মূলত একদিকে যেমন প্রচলিত জ্ঞানে নতুন সংযোজন, অন্যদিকে তেমন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের একটি হাতিয়ার।
প্রতিবেদন লিখনের জন্য বিবেচ্য বিষয় : গবেষণা প্রতিবেদন লিখনের জন্য অন্যান্য বিবেচ্য বিষয়সমূহ হল :
প্রথমত, প্রতিবেদন প্রণয়নে প্রতিবেদনের পাঠক কে বা কারা হবেন তাদের মান বা পর্যায় সম্পর্কে গবেষককে লক্ষ্য রাখতে হয়। ছাত্রদের দ্বারা লিখিত গবেষণার পাঠক থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক ও পণ্ডিতবর্গ।এ ধরনের প্রতিবেদন যথেষ্ট একাডেমিক বা তাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিশ্লেষণাত্মক হয়ে থাকে।
দ্বিতীয়ত, ফলিত গবেষণা, কার্যক্রম গবেষণা, কার্যোপযোগী গবেষণা ইত্যাদি প্রতিবেদনের মূল পাঠক হচ্ছেন নীতি নির্ধারক, পরিকল্পনা প্রণয়নকারী, কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ। এ ধরনের গবেষণা প্রতিবেদনে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অপেক্ষাকৃত থাকেই না।
তৃতীয়ত, সর্বস্তরের দের জন্যও গবেষণা প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। এ ধরনের প্রতিবেদনের প্রকৃতি সহজ সরল হয়।যে শ্রেণীর মানুষের জন্য প্রতিবেদন লেখা হোক না কেন, প্রতিবেদন লেখার সময় প্রতিবেদকের দু’টি বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। যথা :
১. কি তথ্যাবলি পরিবেশন করা প্রয়োজন ? ২.কিভাবে তা উত্তমরূপে পরিবেশন করা যায় ?
গবেষণা প্রতিবেদনের ধরন : গবেষণা প্রতিবেদন আকার-আকৃতির দিক থেকে তিন রকম হতে পারে। যেমন :
১. বিশদ বা বিস্তৃত প্রতিবেদন (যেমন- থিসিস);
২. মাঝারি আকারের প্রতিবেদন (যেমন- কোন জার্নালে প্রকাশের জন্য তৈরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ) এবং
৩. সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন (যেমন- গবেষণার সার সংকলন)।
প্রতিবেদন লেখার প্রচলিত রীতি : কোন সামাজিক গবেষণার একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রতিবেদন লেখার জন্য গুড় এবং হ্যাট (Goode and Hatt) কতকগুলো প্রচলিত রীতি অবলম্বনের কথা বলেছেন। যথা :
৬. প্রথমে সমস্যা উপস্থাপন এবং তাত্ত্বিক প্রস্তাবনার সম্পর্ক নির্ণয় করা।
৭. গবেষণার নকশার বর্ণনা এবং উপাত্ত সংগ্রহ করার পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা।
৮. উপাত্ত বিশ্লেষণ ও গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা।
৯. প্রকল্প ও ফলাফলের সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোচনা করা।
১০. পরিশেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং এর প্রায়োগিক তাৎপর্য ও তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্দেশ করা।
সমাজবিজ্ঞানী মার্গারেট স্টাসি (Margaret stacey) এর মতে, একটি সামাজিক গবেষণার প্রতিবেদনে ফিলিখিত তথ্যাবলি থাকা উচিত। যেমন :
১১. কাদের অর্থানুকূল্যে কে বা কারা গবেষণাটি পরিচালনা করেন।
১২. গবেষণাটির উদ্দেশ্যাবলি।
১৩. গবেষণাটি কখন শুরু এবং শেষ হয়।
১৪. সমষ্টির বৃত্তান্ত, নমুনার আকার ও নমুনায়নের পদ্ধতি।
১৫. গবেষণা পরিচালক, সহকারী ও মাটকর্মীদের প্রাথমিক তথ্যাবলি।
১৬. উপাত্ত সংগ্রহের কলাকৌশল ও উপকরণাদি।
১৭. গবেষণার ফলাফল।
১৮. প্রকল্পের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও সঙ্গতিবিহীন তথ্যাবলি।
১৯. প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে অনুরূপ অন্যান্য গবেষণার ফলাফলের সম্পর্ক।
২০. গবেষণালব্ধ ফলাফলের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক তাৎপর্য।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, গবেষণার প্রতিবেদন লিখন সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত প্রতীয়মান হয় যে, এটা বেশ কঠিন কাজ। প্রতিবেদনে গবেষণার ফলাফলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও সঙ্গতিবিহীন তথ্যাবলি এবং গবেষণাটির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা থাকা উচিত যাতে করে প্রতিবেদনটি অর্থবহুল বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণমূলক হয়। সুতরাং গবেষণার প্রতিবেদনের গুরুত্ব মনোবিজ্ঞানে অনস্বীকার্য।