অথবা, গবেষণা নকশার কী কী উপাদান রয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, গবেষণা নক্কার উপাদানগুলো ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সামাজিক গবেষণায় গবেষণার উদ্দেশ্যকে অর্জন করার জন্য গবেষক প্রাপ্ত সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গবেষণার কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য যে যৌক্তিক কর্মপরিকল্পনা (Logical action plan) প্রণয়ন করেন সাধারণভাবে তাকেই গবেষণা নকশা বলে। একটি গবেষণা নকশার প্রকৃতি নির্ভর করে গবেষণার ধরন, গৃহীত পদ্ধতি এবং গবেষণার উদ্দেশ্যের উপর। তবে গবেষণা যে উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হোক না কেন, গবেষণা কাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য গবেষককে অবশ্যই গবেষণা নকশা প্রস্তুত করতে হয়।
গবেষণা নক্শা উপাদান : গবেষণা নক্শার কিছু উপাদান রয়েছে, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. গবেষণার শিরোনাম: গবেষণা নকশার শুরুতেই গবেষণার শিরোনাম থাকে। সন্তোষ গুপ্তের (Santosh Gupta) মতে, “গবেষণার শিরোনাম যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত ও সুস্পষ্ট হবে। শিরোনামে ব্যবহৃত শব্দগুলো যাতে গবেষণার প্রকৃত অর্থ উপস্থাপন করতে পারে এবং গবেষণার পরিধি চিহ্নিত করতে পারে সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। যেমন- “বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পরিবারের ধরন : একটি গ্রামের কেস স্টাডি শিরোনামটি সংক্ষিপ্ত, সুনির্দিষ্ট এবং সহজবোধ্য। বস্তুতপক্ষে গবেষণার শিরোনাম গবেষণার বিষয়বস্তুকে সংক্ষিপ্ত এবং অর্থপূর্ণভাবে তুলে ধরে।
২. গবেষণার বিষয় সম্পর্কে ভূমিকা : গবেষক যে বিষয় বা সমস্যা নিয়ে গবেষণা করতে চান সে সম্পর্কে একটি সাধারণ ভূমিকা বা বর্ণনা প্রদান করেন যেখানে নির্বাচিত বিষয় বা সমস্যার ঐতিহাসিক বিকাশের প্রসঙ্গটি বিদ্যমান থাকে। ফলশ্রুতিতে সংশ্লিষ্ট বিষয় বা সমস্যাটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করতে সুবিধা হয়।
৩. গবেষণার উদ্দেশ্য : গবেষণার উদ্দেশ্য সংখ্যা কত হবে তা নির্ভর করে প্রধানত গবেষণার পরিধি, গবেষকের আগ্রহ, সময়, আর্থিক সামর্থ্য এবং জনশক্তির উপর। তবে উদ্দেশ্যের সংখ্যা যতই হোক না কেন গবেষণার উদ্দেশ্যসমূহকে সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে গবেষণা নকশায় উল্লেখ করতে। কেননা “গবেষণার উদ্দেশ্য নির্ধারণকে গবেষণাকর্মের কার্যগত নির্দেশনা (Functional guidelines) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।”
৪. গবেষণার যৌক্তিকতা : যে বিষয় বা সমস্যার উপর গবেষণা পরিচালিত হবে, সমাজজীবনে তার যৌক্তিকতা বা গুরুত্ব উল্লেখ করতে হবে। প্রস্তাবিত গবেষণা কাজটি তত্ত্ব গঠনে বা সামাজিক সমস্যা সমধানে কিংবা নীতি প্রণয়নে সহায়তা করবে কিনা তা সুস্পষ্টভাবে গবেষণা নকশায় উল্লেখ করতে হবে।
৫. সাহিত্য পর্যালোচনা : গবেষণা নকশায় সাহিত্য পর্যালোচনা সম্পর্কে পর্যালোচনাকৃত সাহিত্যগুলোর পরিচিতিসূত্রসহ (Reference) বিশদভাবে উল্লেখ করতে হয়। কেননা সাহিত্য পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে গবেষণার জন্য
নির্বাচিত বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত (Related) বিভিন্ন বই, পুস্তিকা, প্রবন্ধ, গবেষণাকর্ম প্রভৃতির সাথে পরিচিতি লাভের চেষ্টা করা হয়।
৬. পূর্বানুমান গঠন : পূর্বানুমান গবেষণার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। তাই গবেষণার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে পূর্বানুমান গঠন করা শ্রেয়। পূর্বানুমানের বিভিন্ন উৎস হতে পারে।
যেমন- কোন মৌলিক তত্ত্ব বা প্যারাডাইম (Paradigm) থেকে পূর্ববর্তী গবেষণার ফলাফল থেকে, কিংবা গবেষকের সৃজনশীল কল্পনা বা অভিজ্ঞতা থেকে। গবেষণার পরবর্তী পর্যায়সমূহে গৃহীত পূর্বানুমানটির সত্যাসত্য যাচাই করা হয়।
৭. প্রত্যয়ের কার্যকরী সংজ্ঞা : গবেষণায় ব্যবহৃত প্রত্যয়সমূহকে প্রয়োগযোগ্য, যাচাইযোগ্য ও পরিমাপযোগ্য করার জন্য সেগুলোর কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান একান্ত অপরিহার্য। কেননা একটি প্রত্যয় বিভিন্ন গবেষণায় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন— ‘শ্রেণী’, ‘ক্ষমতা’, ‘অপরাধ’, ‘ভূমিহীন’, ‘দুঃস্থ’ প্রভৃতি প্রত্যয়গুলো বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। তাই গবেষণায় ব্যবহৃত প্রত্যয়গুলো গবেষক কোন বিশেষ অর্থে ব্যবহার করবেন এবং তার পরিধি কতটুকু হবে তা কার্যকরী সংজ্ঞা দ্বারা নির্দিষ্ট করতে হবে।
৮. উপাত্তের উৎস : গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্ত কোন উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে তা গবেষণা নকশায় উল্লেখ করতে হবে। উপাত্ত দু’ধরনের উৎস থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে। যথা :
ক. প্রাথমিক উৎস : গবেষণাধীন বিষয়ের বাস্তব ক্ষেত্র থেকে সরাসরি সংগৃহীত উপাত্ত যেগুলো সাধারণত কোন গবেষণায় ব্যবহৃত হয় নি সেগুলোকে প্রাথমিক উপাত্ত বলে।
খ. মাধ্যমিক উৎস : বই-পুস্তক, সংবাদপত্র, দলিলপত্র, নথি, বিভিন্ন সরকারি দফতরের বার্ষিক প্রতিবেদন, গবেষণাকর্ম প্রভৃতি উৎস থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হলে সেগুলোকে মাধ্যমিক উপাত্ত বলে। কোন ধরনের উৎস থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে তা নির্ভর করে গবেষণার বিষয়বস্তু এবং গবেষকের ইচ্ছার উপর। তবে গবেষণার প্রয়োজনে গবেষক উভয় উৎস থেকেই উপাত্ত সংগ্রহ করে থাকেন।
৯. উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতি : সামাজিক গবেষণায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে গবেষণার জন্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। যেমন-পর্যবেক্ষণ সাক্ষাৎকার, প্রশ্নমালা, কেসস্টাডি, পরীক্ষণ ইত্যাদি। প্রস্তাবিত গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্তসমূহ কোন পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হবে, কেন এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে তার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শনপূর্বক গবেষণা নকশায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
১০. তথ্য বিশ্ব বা সমগ্রক : গবেষণা এলাকার অন্তর্ভুক্ত যে তথ্য বিশ্ব বা সমগ্রক থেকে প্রয়োজনীয় উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে, গবেষণা নকশায় তার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে হবে। সমগ্রক থেকে শুমারি পদ্ধতিতে অর্থাৎ সমগ্রকের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি নমুনা একক (Sample unit) থেকে, নাকি নমুনায়ন পদ্ধতি অবলম্বন করে উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে তা গবেষণা নকশায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
১১. উপাত্তের নির্ভরযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা: সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ এবং নির্ভরযোগ্য উপাত্তের উপরই গবেষণার সফলতা নির্ভর করে। কিন্তু সামাজিক গবেষণায় সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ এবং নির্ভরযোগ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা বেশ কঠিন কাজ। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষিত, অভিজ্ঞ এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত উপাত্ত সংগ্রহকারী, সঠিক প্রশ্নমালা প্রণয়ন, প্রশ্নমালার পূর্ব-যাচাইকরণ (Pre-test), যথাযথ তত্ত্বাবধান (Proper inspection) গবেষকের সচেতনতা ইত্যাদি।
১২. উপাত্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিশ্লেষণ : গবেষণার জন্য সংগৃহীত উপাত্তের যথাযথ বিশ্লেষণের উপরই গবেষণার ফলাফল নির্ভর করে। তাই উপাত্ত সংগ্রহ শেষ করার পর কিভাবে উপাত্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিশ্লেষণ করা হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা গবেষণা নকশা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। উপাত্ত যদি প্রশ্নমালা বা সাক্ষাৎকার অনুসূচি (Interview schedule) ব্যবহার করে সংগ্রহ করা হয় তাহলে সেগুলোর সম্পাদনা (Editing), সংকেতায়ন (Coding), শ্রেণীকরণ (Classification) ও সারণি বদ্ধকরণ (Tabulation) করতে হয়।
১৩. সময়সূচি : গবেষণার কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য কত সময়ের প্রয়োজন এবং গবেষণার কোন পর্যায়ের জন্য কত সময় ব্যয় করা হবে তা গবেষণা নকশায় উল্লেখ করতে হবে। গবেষণার নকশা প্রণয়ন, প্রশ্নমালা তৈরিকরণ, উপাত্ত সংগ্রহ, উপাত্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ, উপাত্ত বিশ্লেষণ, গবেষণা প্রতিবেদন তৈরিকরণ প্রভৃতি প্রতিটি পর্যায়ের সময়ের বণ্টন পৃথকভাবে উল্লেখ করতে হবে।
১৪. বাজেট : গবেষণা নকশার একটি গুরু পূর্ণ অংশ হলো বাজেট। কেননা যে কোন গবেষণাকার্য পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোন উৎস থেকে পাওয়া যাবে এবং প্রাপ্ত অর্থ কোন কোন খাতে যেমন- পারিশ্রমিক ব্যয়, ভ্রমণ ব্যয়, মনোহারি দ্রবাদি ক্রয়, ডাক খরচ, ছাপা খরচ প্রভৃতি কিভাবে ব্যয় করা হবে গবেষণা নকশায় তার বিশদ বিবরণ থাকবে।
১৫. কর্মচারী : গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য একজন গবেষক প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মী নিয়োগ করে থাকেন। যেমন- মাঠ পর্যায় থেকে উপাত্ত সংগ্রাহক, উপাত্ত বিন্যস্তকারী, তত্ত্বাবধায়ক,
পরিসংখ্যানবিদ, মুদ্রাক্ষরিক প্রমুখ। এসব ব্যক্তিবর্গের কার সাহায্য গবেষণার কোন পর্যায়ে প্রয়োজন, কতজন কর্মচারীর প্রয়োজন, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ গবেষণা নকশায় উল্লেখ করতে হয়।
১৬. গ্রন্থপঞ্জি : গবেষণা নকশায় গবেষণার বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত বই, গবেষণা প্রতিবেদন, জার্নাল, প্রবন্ধ,মানচিত্র, সংবাদপত্র প্রভৃতির একটি তালিকা যা গবেষণায় ব্যবহৃত হবে তা উল্লেখ করতে হবে। এই তালিকাকে গ্রন্থপঞ্জি বলে। গ্রন্থপঞ্জি সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুসরণ করে প্রণয়ন করতে হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, নির্দিষ্ট সময় ও নির্ধারিত অর্থের সদ্ব্যবহার করে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার জন্য একটি উত্তম গবেষণা নকশায় উপর্যুক্ত বিষয়সমূহই মূলত অন্তর্ভুক্ত থাকে।