অথবা, জনমতের বাহনগুলো আলোচনা কর।
অথবা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনমত গঠনের মাধ্যমগুলো আলোচনা কর।
অথবা, জনমত গঠনের মাধ্যমসমূহ আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : জনমত সম্পর্কিত ধারণার উৎপত্তির ইতিহাস অস্পষ্ট। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় জনমত কথাটি নতুন নয়। তবে জনমত সংক্রান্ত ধারণা মোটামুটি প্রাচীন। গ্রিক এবং রোমান আইনে জনমত সম্পর্কিত ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়। মধ্যযুগেও এ ধারণা প্রচলিত ছিল। তবে এ সময়কার চিন্তাবিদদের লেখায় এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার অভাব ছিল। সর্বপ্রথম ফরাসি দার্শনিক রুশো এর রচনায় ‘জনমত’ এর রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়।
জনমত গঠন ও প্রকাশের মাধ্যমসমূহ : সুসংগঠিত এবং সদাজাগ্রত জনমত ছাড়া গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। জনমত গণতন্ত্রের প্রাণস্বরূপ। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্রের সাফল্যের মূলভিত্তি হলো সুস্থ ও সুচিন্তিত জনমত। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমত গঠন ও প্রকাশের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে কতকগুলো মাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জনমত গঠন ও প্রকাশের মাধ্যমগুলো নিম্নরূপ :
১. বেতার, চলচ্চিত্র ও দূরদর্শন: সংবাদপত্রের প্রভাব কেবল শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু বেতার ও চলচ্চিত্রের আবেদন শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলের কাছে পৌঁছায়। বেতার প্রচারের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কিত সর্বশেষ খবর দেশে সর্বত্র তড়িৎ গতিতে পৌঁছে দেয়া হয়। বেতারের মতো চলচ্চিত্র সর্বসাধারণের মধ্যে সংবাদ ও তথ্যাদি পরিবেশনের ব্যাপারে এক অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। জনগণের মধ্যে বেতার ও চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার ফলে জনগণের মধ্যে এদের প্রভাবও ক্রমশ বাড়ছে।
২. মুদ্রণযন্ত্র : জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে মুদ্রণযন্ত্রের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণে সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র, পুস্তক-পুস্তিকা এবং বিভিন্ন বক্তব্য ও মন্তব্য ছাপার অক্ষরে জনসমক্ষে হাজির হয়। সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণ দেশবিদেশের বিভিন্ন বিষয়ে ওয়াকিবহাল হওয়ার সুযোগ পায়। তাছাড়া সংবাদপত্রের সংবাদ ভাষা, সম্পাদকীয় স্তম্ভের মন্তব্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জনসাধারণের মতামতকে প্রভাবিত করে। আবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত চিঠিপত্রের মাধ্যমে জনগণ নানা বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে এবং নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে।
৩. আইনসভা : জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে আইনসভা গঠিত হয়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, তারাই মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে এবং শাসনকার্য পরিচালনা করে। অন্যান্য দলগুলো বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করে। সরকারি দল এবং বিরোধী দলগুলো তর্কবিতর্ক, প্রশ্নোত্তর, সমালোচনা প্রভৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক মতামত ব্যক্ত করে। বিরোধী দলের প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রিগণ আইনসভায় যেসব তথ্য পরিবেশন করেন, তা নির্ভরযোগ্য সরকারি সূত্রে সংগৃহীত হয়ে থাকে। ৪. পরিবার পিতামাতা ও পরিবারের
অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠদের মতাদর্শ ও ধ্যানধারণা শিশু ও কিশোর মনকে প্রভাবিত করে। পরিবারের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি সদস্যদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এ প্রভাব ভবিষ্যতে রাজনৈতিক মতামত গঠনের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়। পরিবারের মধ্যে দেশের বিভিন্ন সমস্যা ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এ আলোচনার মাধ্যমে পরিবারের শিশু ও কিশোর সদস্যদের রাজনৈতিক মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে। প্রকৃত প্রস্তাবে। পরিবারের মধ্যেই ব্যক্তি বিভিন্ন মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রথম পাঠ গ্রহণ করে।
৫. সংবাদপত্র: বর্তমান যুগে জনমত
গঠন ও প্রকাশে সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। সংবাদপত্র সত্য মানুষের নিত্যসঙ্গী। সংবাদপত্র কেবল সংবাদই পরিবেশন করে না, এটি জাতীয় সমস্যাদির উপর মতামত ব্যক্ত করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সংবাদপত্র দেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে শিক্ষাবিদ এবং মনীষীদের প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশ করে জনমত গঠনে সাহায্য করে থাকে। তাছাড়া জনগণের বিভিন্ন দাবিদাওয়া, আচার-অনুষ্ঠান ও বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের মতামত সংবাদপত্রে স্থান পায়। ফলে জনগণের মতামত ও দাবিদাওয়া সম্পর্কে সরকার অবহিত হতে পারে।
৬. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : জনমত গঠনের ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। স্কুল,
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট পাঠক্রমের সঙ্গে সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বহু বিষয়ে আলোচনা করা হয়। সেসব আলোচনায় দেশের সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি সমস্যা ও তার সমাধান সংক্রান্ত বিষয়ও স্থান পায়। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এসব বিষয়ে সম্যক ধারণা জন্মায়। আর স্কুল কলেজের চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণা ছাত্রছাত্রীদের উপর এক স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। তাছাড়া শিক্ষক শিক্ষিকাদের ব্যক্তিত্ব এবং তাদের রাজনৈতিক মতামত ছাত্রছাত্রীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
৭. ধর্মীয় সংঘ : জনমত গঠনে ধর্মীয় সংঘগুলোর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। অনেক ধর্মীয় নেতা সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেন এবং রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন। দেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্বন্ধে তারা মতামত দিয়ে ভক্তদের প্রভাবিত করেন। অ্যালমন্ড ও পাওয়েল বলেন, “ধর্মীয় সংঘের কার্যকলাপের ফলে মানুষের রাজনৈতিক জ্ঞান বৃদ্ধি পায়।
৮. সভাসমিতি : জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে সভাসমিতিও হলো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সভাসমিতি ও সমাবেশের মাধ্যমে সুদূর গ্রামাঞ্চলেও শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের কাছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী তাদের বক্তব্য পৌঁছে দিতে পারে। সভাসমিতিতে দেশের চিন্তাশীল ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ দেশের সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা, তার প্রকৃতি ও সমাধানের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করেন ।
৯. আলাপ আলোচনা: অনেক সময় জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর উপর জনগণ আলাপ আলোচনা বৈঠক পথসভার মাধ্যমেও জনমত সৃষ্টি করতে পারে।
১০. নির্বাচন : নির্বাচনও জনমত সৃষ্টি করতে পারে। দেশের নির্বাচনের সময় প্রত্যেক রাজনৈতিক দল স্ব-স্ব মনোনীত প্রার্থীকে জারী করার জন্য দেশের সমস্যাগুলোর উপর ভিত্তি করে তাদের বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি
করে থাকে।
১১. পেশা বা ব্যবসায়: ব্যক্তি তার পেশা বা ব্যবসায় বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করে। এ অভিজ্ঞতা নতুন মত গ্রহণ বা পুরাতন মত পরিবর্তনে সাহায্য করে। পেশাভিত্তিক সংঘ যেমন- শ্রমিক ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি জনমতকে
প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, শুধু জনমত গঠন ও প্রকাশের জন্য একদিকে যেমন জনমতের মাধ্যমগুলোর প্রয়োজন, অন্যদিকে তেমনি মতামত গঠন ও প্রকাশের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন। অন্যথায় সুষ্ঠু ও সবল জনমত গঠিত ও প্রকাশিত হতে পারবে না। বলাবাহুল্য, সুষ্ঠু জনমতের অভাবে গণতন্ত্র শূন্যগর্ভ তত্ত্বকথায় পর্যবসিত হতে বাধা।