গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা আলোচনা কর।

অথবা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের অবদান লিখ।
অথবা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের কি কোনো অবদান আছে? যুক্তি দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গণতন্ত্রকে সকল করতে হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সফল হতে হবে। কারণ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সরাসরি তৃণমূলের কাছে গণতন্ত্র পৌঁছানো সম্ভব হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়, একমাত্র স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার
মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব। তাই স্থানীয় সরকারকে কেন্দ্রীয় দিক নিদের্শনার বাস্তবায়নকারী বলা যায়। তাই বলা যায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য ।
গণতন্ত্র ও স্থানীয় সরকার : “গণতন্ত্র বলতে এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে শাসন ক্ষমতা এক বা মুষ্টিমেয় লোকের হাতে ন্যস্ত না থেকে সমগ্র জনসাধারণের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং অধিকাংশ জনগণকে মতামত প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া হয়।” “প্রশাসনিক সুবিধার জন্য প্রত্যেকটি দেশকে কতিপয় প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। এ ভাগগুলোর আবার সীমিত কর্তৃত্বসম্পন্ন সংগঠন থাকে। এরূপ সংগঠনকে স্থানীয় বা স্থানীয় শাসন বলা হয়।” স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা : নিম্নে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
১. গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ : কথায় বলে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে স্থানীয় সরকারকে কার্যকরী করতে হবে। কারণ স্থানীয় সরকার জনগণের মাঝে জাতীয়তাবোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সরকারের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজনীতিতে নাগরিকদের হাতেখড়ি শুরু হয়, একপর্যায়ে জাতীয় নেতা তৈরি হয়। তাই বলা যায়, গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা বা গুরুত্ব অপরিসীম।
২. উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের বাস্তবায়ন করে। গণতান্ত্রিক বিকাশে স্থানীয় সরকার কাজ করে। স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাট নির্মাণ, ব্রিজ, কালভার্ট স্থাপন, সবুজ বনায়ন, পার্ক নির্মাণ, হাসপাতাল, কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণে স্থানীয় সরকার অংশগ্রহণ করে।
৩. দায়িত্বশীলতা : স্থানীয় সরকারের অন্যতম প্রবীণ কাজ জনগণের মাঝে গণতান্ত্রিক দায়িত্বশীলতার সৃষ্টি করা। এর জন্য স্থানীয় সরকার জনগণের বুদ্ধি, প্রতিভা, মনোবল কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। গ্রাম পর্যায়ের উন্নয়নে স্থানীয় সরকার অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে থাকে।
৪. নির্বাচন পরিচালনা : স্থানীয় সরকার স্থানীয় পর্যায়ের সকল নির্বাচন ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে পরিচালনা করে। বলা হয় যে, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মূল হাতিয়ার হল স্থানীয় সরকার। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে স্থানীয় সরকারের সাহায্য সহযোগিতা একান্তভাবে আবশ্যক ।
৫. উন্নয়নের মাপকাঠি : কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দেখেই বোঝা যায় গণতন্ত্র কতখানি সকল। পাশ্চাত্য সভ্যতার উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রেও একই হয়েছিল, প্রথমে তারা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে জনকল্যাণমুখী এবং দায়িত্বশীল করেছিল, যার কারণেই আজ তারা উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে।
৬. কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের বাস্তবায়নকারী : স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ বাস্তবায়িত করে থাকে।
অনেক আইন, কাজ, নির্দেশ আছে যেগুলি কেন্দ্র থেকে বাস্তবায়ন বা পর্যবেক্ষণ করা বেশ দুসাধ্য ব্যাপার। স্থানীয় সরকার সে কাজগুলি সহজে বাস্তবায়ন করে থাকে।
৭. নাগরিকের সচেতনা বৃদ্ধি : স্থানীয় সরকার নাগরিকদের রাজনৈতিক শিক্ষাদান করে। নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে উৎসাহিত করে নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতন করে তোলে।
৮. জনগণের চাহিদার বাস্তবায়ন : স্থানীয় সরকার জনগণের চাহিদার বাস্তবায়ন করে থাকে। জনগণ কী চায়, চাওয়া পাওয়া, দাবি, আশা-আকাঙ্ক্ষা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে মেটানো বা নজর দেওয়া সম্ভব নয় তাই এসব চাহিদা একমাত্র স্থানীয় সরকারই ভালোভাবে মিটাতে সক্ষম।
৯. গতিশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি : স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে গতিশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হয়। স্থানীয় রাজনীতির মাধ্যমে একজন সাধারণ নাগরিক জাতীয় নেতায় পরিণত হতে পারে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যদি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা না থাকে তবে দেশ কোনো যোগ্য নেতা পায় না।
১০. লাল ফিতার দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম একটি সমস্যা হলো লাল ফিতার দৌরাত্ম্য। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে জনগণের কাছে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। জনগণের সমস্যা, অসুবিধা যদি স্থানীয় পর্যায়েই মিটে যায় তবে জনগণ দীর্ঘসূত্রিতার কবল থেকে মুক্তি পেয়ে গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করতে পারবে।
১১. দুর্যোগকালীন সেবা ও পূনর্বাসনে : স্থানীয় সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সমস্যার দ্রুত এবং কার্যক্ষম সমাধান করতে সক্ষম। স্থানীয় জনগণকে কেন্দ্রের সুষ্ঠুভাবে সরকার থেকে নিরূপণ করে সেবা পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তাই স্থানীয় সরকারই এক্ষেত্রে সেরা ভরসা।
১২. জনকল্যাণ এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় : গণতন্ত্রের মূলকথা জনকল্যাণ সাধন করা। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে দেশের সকল জনগোষ্ঠীর জনকল্যাণ সাধন এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে গণতন্ত্র রক্ষায় বা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারই একমাত্র ভরসা।
১৩. স্থানীয় আয়ের উৎস : স্থানীয় সরকার স্থানীয়ভাবে আয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করে, বাস্তবায়ন করে এবং ব্যয় ঠিক করে। তাছাড়া স্থানীয় সরকার সঠিকভাবে রাজস্ব কর আদায়ে কেন্দ্রকে সাহায্য করে। এছাড়াও স্থানীয় সরকার দেশের জনগণকে আইনগতভাবেও সহযোগিতা প্রদান করে।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, গণতন্ত্রের প্রাণ হলো স্থানীয় সরকার। স্থানীয় সরকার যত শক্তিশালী হবে গণতন্ত্র তত মজবুত সু-দৃঢ় হবে। স্থানীয় সরকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের অবদান অনেক গুরুত্বপূর্ণ ।