কোন কোন উপাদানের উপর গতিশীলতা নির্ভরশীল তা আলোচনা কর।

অথবা, দলীয় গতিশীলতার উপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, দলীয় গতিশীলতার উপর প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়বস্তু আলোচনা কর।
অথবা, দলীয় গতিশীলতার উপর প্রভাব বিস্তারকারী মানদণ্ড আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : দলীয় গতিশীলতা একটি চলমান ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া একটি দলের মধ্যে নানাবিধ পরিবর্তনের মাধ্যমে যেমন সংঘটিত হয়, তেমনি এর ফলে দলেও অনেক পরিবর্তন আসে। তবে একটা দল সবসময় একই রকম গতিশীলতার পরিচয় বহন করে না। গতিশীলতার মাধ্যম একটি দলে তাই কখনও বেশি আবার কখনও কম। এখানে কতকগুলো উপাদান রয়েছে যা দলীয় গতিশীলতাকে প্রভাবিত করে।
দলীয় গতিশীলতার উপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান/যে সকল উপাদানের উপর দলীয়
গতিশীলতা নির্ভরশীল : দলীয় গতিশীলতাকে প্রভাবিত করে এমন উপাদানগুলো হলো :
১. ব্যক্তির অবস্থানগত ভূমিকা : দলের সদস্য হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তির দলে একটি অবস্থান রয়েছে। ব্যক্তি হয় দলের সদস্য নয়তো নেতা বা নিয়ন্ত্রক। দলে ব্যক্তির যে অবস্থানই হোক না কেন, স্বীয় অবস্থান অনুযায়ী ব্যক্তি ভূমিকা
পালন করে। দলে মানুষের অবস্থানগত ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে দল গতিশীল হয়। এক্ষেত্রে দলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক ভালোও হতে পারে আবার মন্দও হতে পারে। অর্থাৎ সদস্যদের সাথে ব্যক্তির ভূমিকা ইতিবাচকও হতে পারে আবার নেতিবাচকও হতে পারে। এ সম্পর্ক দলকে গতিশীল রাখতে সাহায্য করে।
২. ব্যক্তির ক্রিয়া : দলে ব্যক্তি বিভিন্ন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ থেকে বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়া করে। বিভিন্ন ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপের মধ্যে পার্থক্য থাকে। এগুলোর কোনটি দলের অন্যান্য সদস্যরা করে এবং কোন কোনটি বর্জন করে। মূলত ব্যক্তির যে ক্রিয়াগুলো সদস্যদের স্বার্থ, মনোভাব, প্রত্যাশা, চাহিদা প্রভৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ হয় সেগুলোই দলীয়
সদস্যরা গ্রহণ করে। অন্যদিকে, যে ক্রিয়াগুলো দলের সদস্যদের স্বার্থবিরোধী হয় কিংবা মূল্যবোধ ও প্রত্যাশার সাথে অসংগতিপূর্ণ হয় সেগুলো তারা বর্জন করে। এভাবে ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপ বর্জন ও গ্রহণের মধ্য দিয়ে দল গতিশীল হয়।
৩. উপদল : দলের মধ্যে অনেক সময় উপদলের অস্তিত্বও লক্ষ্য করা যায়। দলের সদস্যদের পারস্পরিক মনোভাব, দর্শন, মূল্যবোধ, চাহিদা, স্বার্থ, ইজম ইত্যাদির কারণে উপদল সৃষ্টি হয়। দলের মধ্যে বিভিন্ন উপদলের এরূপ মিথস্ক্রিয়াও দলকে গতিশীল রাখে । উপদল দু’জন, তিনজন মিলে যেমন হতে পারে তেমনি অনেক সদস্য মিলেও হতে পারে। উপদলে উপদলীয় নেতৃত্ব থাকে। উপদল একদিকে যেমন দলীয় গতিশীলতার সৃষ্টি করে তেমনি অনেক সময় দলীয় ভাঙন সৃষ্টিতেও অবদান রাখে। বড় ধরনের সামাজিক দলগুলোতে অনেক সময় মতভেদগত পার্থক্যের কারণে বিভক্তি দেখা যায় যা দলের জন্য অকল্যাণকর। অনেক সময় আবার এ মতভেদের কারণে দলে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় থাকে। যেমন- দলীয় নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলে একাধিক প্যানেল সৃষ্টি হতে পারে। নির্বাচনে যে প্যানেল বেশি ভোট পায় সে প্যানেল থেকে নেতা নির্বাচন করা হয়।
৪. দলীয় নেতৃত্ব : দলের নেতার গুণাবলি, কর্মদক্ষতা, পারদর্শিতা, জনপ্রিয়তা, নৈতিকতা, বাগ্মিতা, যোগ্যতা ইত্যাদির উপর দলের ভালোমন্দ অনেকাংশে নির্ভর করে। একজন দক্ষতাসম্পন্ন, দূরদর্শিতাসম্পন্ন, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ও যোগ্য নেতা দলকে গতিশীল ও বেগবান রাখতে সাহায্য করে। পক্ষান্তরে, একজন অদক্ষ, অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন, অযোগ্য ও মানবিক গুণবর্জিত নেতা তার দুর্বল নেতৃত্বের কারণে দলের ভাঙন ডেকে আনতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আবার দলে
বিদ্রোহও দেখা দিতে পারে, যা দলে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে এবং দলকে গতিশীল করতেও সাহায্য করে।
৫. দলীয় কাঠামো : দলীয় সদস্যদের পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া দ্বারা য ে সুসংবদ্ধ ও নিবিড় দলীয় সম্পর্ক গড়ে উঠে তাই দলীয় কাঠামো। দলীয় কাঠামো অনুযায়ী দলে বিভিন্ন ধরনের সদস্য থাকে। ধরনভেদে তারা স্ব-স্ব ভূমিকা পালন করে। বড় ধরনের সামাজিক দলে দলের সভাপতি, সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, উপদেষ্টা, সদস্য সচিব, প্রচার সম্পাদক, সাধারণ সদস্য ইত্যাদি থাকে। এসব সদস্য কেন্দ্র অনুযায়ী স্ব-স্ব ভূমিকা পালন করে।
৬. দলীয় বন্ধন : দলীয় বন্ধন দলীয় গতিশীলতার একটি অন্যতম উপাদান। একত্রে বসবাস কিংবা একত্রে কাজ করতে গিয়ে অথবা একই আদর্শ ও মূল্যবোধগত বিশ্বাসের কারণে দলীয় বন্ধনের সৃষ্টি হয়। দলীয় বন্ধন দলের সদস্যদের পারস্পরিক আনুগত্য, মমত্ববোধ, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, সহযোগিতা ও একত্ববোধের অনুভূতিকে মজবুত করে। সর্বোপরি দলীয় বন্ধন দলীয় সদস্যদের মাঝে ‘আমরা অনুভূতিকে’ মজবুত করে। দলীয় বন্ধন যত সুদৃঢ় হয় ততই দলের জন্য
মঙ্গল । অন্যদিকে দলীয় বন্ধন শিথিল হলে তা দলের জন্য অমঙ্গল ।
৭. পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়া : দলের সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্বসংঘাত ইত্যাদির মাধ্যমে সবসময় দলে একটি মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়া বিদ্যমান থাকে। এর মাধ্যমে দলীয় কর্মকাণ্ড প্রাণবন্ত ও ক্রিয়াশীল হয়। সেজন্য এটি হলো দলীয় গতিশীলতার প্রধান উপাদান এবং একইভাবে মুখ্য পরিচয়বাহী। বস্তুত মিথস্ক্রিয়ার উপরই দলীয় অস্তিত্ব এবং গতিশীলতার মূলভিত্তি।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যে কোন দলের জন্য দলীয় গতিশীলতা জরুরি। দলীয় এ গতিশীলতা দলের মধ্যে কখনও দেখা যায় খুব দ্রুত বহমান, আবার কখনও বা খুব স্মথগতিতে বহমান, যা আলোচ্য উপাদানগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এসব উপাদানগুলো একটি দলকে সজীবতা দান করে, দলকে গতিশীল করে। এগুলো না থাকলে দল নির্জীব হয়ে যাবে। দলের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই দলের উপর প্রভাব বিস্তারকারী এসব উপাদান প্রয়োজন।