অথবা, দলীয় দ্বন্দ্বের সংজ্ঞা দাও। দলীয় দ্বন্দ্বের কারণগুলো কী কী? কিভাবে দলীয় দ্বন্দ্ব দূর করা যায় তা আলোচনা কর।
অথবা, দলীয় দ্বন্দ্ব বলতে কী বুঝ। দলীয় দ্বন্দ্ব নিরসনের উপায় কী কী? কিভাবে দলীয় দ্বন্দ্ব বাদ দেয়া যায় তা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলীয় মিথস্ক্রিয়া সম্পাদিত হয় সেগুলোর মধ্যে দলীয় দ্বন্দ্ব অন্যতম। সমাজজীবনে বা দলীয় জীবনে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার নেতিবাচক দিক হলো দলীয় দ্বন্দ্ব। এটি দলীয় গতিশীলতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নানাবিধ কারণে দলীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এটি দলের এমন একটি অবস্থা যা দলের সদস্যদের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে এবং সমস্ত দলের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে দলের সদস্যদের উন্নয়ন ব্যাহত হয় এবং দলীয় গতিশীলতার ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এজন্য সঠিক উপায়ে যথাসময়ে দলীয় দ্বন্দ্ব নিরসন করা জরুরি।
দলীয় দ্বন্দ্বের কারণ : পৃথিবীতে এমন কোন দল নেই যেখানে দ্বন্দ্ব নেই। সাধারণত স্বার্থকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় এবং একপক্ষ অন্যপক্ষকে দুর্বল কিংবা নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টায় দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। যেসব কারণে সাধারণত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় তা নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. সদস্যদের মাঝে স্বার্থের সংঘাত : দলীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধারে যখন কেউ মেতে উঠে তখনই দলীয় উচ্ছৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মালিক শ্রেণির সাথে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের সংঘাতের কারণে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
২. ক্ষমতার লড়াই : দলের ভিতর শিক্ষিত ও প্রতিপত্তিসম্পন্ন লোক বেশি থাকলে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা দেখা দেয়। কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কারো নেতৃত্ব মেনে নিতে চায় না এবং তাদের মধ্যে প্রত্যেকেই ক্ষমতাবান হতে চায়। এতে দলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
৩. ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব : একটি দলে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষাপটে সদস্যদের ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন ধরনের হয়। এসব ভিন্ন ব্যক্তিত্বের সদস্যরা যখন একসাথে কাজ করে তখন বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে মতভেদ দেখা দেয়। ফলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
৪. সাংস্কৃতিক ভিন্নতা : সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধগত ভিন্নতাও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে পারে। মূল্যবোধগত পার্থক্যের কারণে একজন বা একটি গোষ্ঠী যা পছন্দ করে তা অন্যজন বা অন্য গোষ্ঠীর অপছন্দের বিষয় হতে পারে। ফলে এক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব দেখা যায়।
৫. প্রতিযোগিতা : স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা মানবসমাজের উন্নতি সাধন করে। কিন্তু অসম প্রতিযোগিতা মানুষকে অনেক সময় অসৎ চিন্তার দিকে ধাবিত করে। অসম প্রতিযোগিতা অনেক সময় স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে মানুষকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের দিকে ধাবিত করে। ফলে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি হয়।
৬. বিশেষ কয়েকজন সদস্যের আধিপত্যমূলক ব্যবহার : দলের মাঝে প্রভাব বিস্তারকারী কতিপয় ব্যক্তি দলের অন্যান্য সদস্যদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, যা দলের সদস্যরা মানসিকভাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। এরূপ পরিস্থিতিতে সাধারণ সদস্যরা আধিপত্য বিস্তারকারীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে ও বিদ্রোহ করতে পারে।
ফলে চরম দ্বন্দ্বে সংঘর্ষ বাধে ও দলীয় স্থায়িত্ব অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
৭. পারস্পরিক যোগাযোগ শূন্যতা ও ভুল বুঝাবুঝি : সদস্যদের মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগ হ্রাস পেলে সুষ্ঠু পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া ঘটে না ও ভুল বুঝাবুঝি শুরু হয়। আর এরূপ ভুল বুঝাবুঝি থেকে দলীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
৮. সদস্যদের সামাজিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বৈসাদৃশ্য : দলের সদস্যদের ভিতর সামাজিক মর্যাদা, সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনা ও মূল্
যবোধ ইত্যাদির বৈসাদৃশ্য থাকলে পারস্পরিক বৈরী মনোভাব গড়ে উঠতে পারে। কালক্রমে সদস্যদের এ ধরনের বৈসাদৃশ্য ও বৈরী মনোভাব দ্বন্দ্ব সংঘাত সূচিত করে।
৯. গণতান্ত্রিক নীতিমালার অনুপস্থিতি : দলের সুষ্ঠু বিকাশধারার জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক নীতিমালার চর্চা। কিন্তু দলে যদি গণতান্ত্রিক নীতিমালার চর্চা করা না হয় এবং দলের সদস্যদের মতামতের যদি কোন মূল্য না দেয়া হয়, তাহলে দলের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ ক্ষোভ থেকেও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, নানাবিধ কারণে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে। এসব দ্বন্দ্বের কারণে দলে নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয়।
দলীয় দ্বন্দ্ব দূর করার উপায় : দলীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টির কারণসমূহ দূর করার মাধ্যমে দলীয় দ্বন্দ্ব নিরসন করা যায়। নিম্নে দলীয় দ্বন্দ্ব দূর করার উপায়সমূহ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
ক. পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত দলীয় সদস্যদের বা উপদলকে দল থেকে বহিষ্কার করা।
খ. সংঘাতে লিপ্ত দলীয় সদস্যদের বা ক্ষুদ্রতর অংশকে প্রভাব বিস্তার করে বশীভূত করা বা দমন করা।
গ. সংঘাতে লিপ্ত সদস্য বা উপদলসমূহের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে আপস নিষ্পত্তির দ্বারা দলীয় দ্বন্দ্ব দূর করা।
ঘ. দলীয় উদ্দেশ্য ও স্বার্থকে রক্ষার জন্য সংঘাতে লিপ্ত উপদল ও সদস্যদের মতামত বিশ্লেষণ করে কোন দলের কোন মত গ্রহণযোগ্য তা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে দলীয় দ্বন্দ্ব দূর করা।
ঙ. গণতান্ত্রিক পন্থা ও নীতিমালা অনুসরণের ব্যবস্থা করা।
চ. যোগ্য ও আস্থাভাজন ব্যক্তিকে নেতৃত্ব গ্রহণে উৎসাহিত করা।
ছ. ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার ও দলগত আলোচনার মাধ্যমে সদস্যদের সংকীর্ণ মনোভাব দূরীকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করা
ও তাদেরকে আত্মসচেতন করে তোলা।
জ. সদস্যদের মৈত্রীভাব জাগিয়ে তোলা ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক শক্তিশালী করা।
ছ. সুষ্ঠু ভূমিকা পালনে দলীয় নেতৃত্বকে সহায়তা করা।
দলীয় দ্বন্দ্ব দলের অন্যতম একটি সমস্যা যা দলের গতিশীলতায় বাধা সৃষ্টি করে। এজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে দলীয় দ্বন্দ্ব দূর করা প্রয়োজন। উপর্যুক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করলে দলীয় দ্বন্দ্ব দূর করা সম্ভব।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, দ্বন্দ্ব দলীয় জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর ফলে দলের সদস্যদের যেমন নানাবিধ সমস্যা হয়, তেমনি দলের গতিশীলতা রোধ করে। বিভিন্ন কারণে দলীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে। এর কারণ খুঁজে বের করে তাই সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। দলীয় দ্বন্দ্ব কারণের সাথে মিল রেখে বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে এ দ্বন্দ্ব দূর করা যায়।