অথবা, নজরুলের আত্মশক্তি,দ্রোহচেতনা ও সেবাধর্ম সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, নজরুলের আত্মশক্তি,দ্রোহচেতনা ও সেবাধর্ম সংক্ষেপে যা জান লিখ।
অথবা, নজরুলের আত্মশক্তি,দ্রোহচেতনা ও সেবাধর্ম সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : কাজী নজরুল ইসলাম দার্শনিক অপেক্ষা কবি হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। আমরা তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে তাঁর দর্শনচিন্তা সম্পর্কে জানতে পারি। তাঁর দার্শনিক চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে তার কাব্য, গান, উপন্যাস ও নাটকে। এগুলোতে আমরা নজরুলের আত্মশক্তি, দ্রোহচেতনা ও সেবাধর্মের পরিচয় পাই যা দেশ কালের ধূমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকতায় পরিণত হয়েছে। তিনি মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছেন; জীবনের সকল দিকই উঠে এসেছে তাঁর রচনায়।
নজরুলের আত্মশক্তি, দ্রোহচেতনা ও সেবাধর্ম : নজরুল ছিলেন একজন বড় মাপের কবি ও দার্শনিক। তিনি যতটা রোমান্টিক ছিলেন, ততটাই ছিলেন বৈপ্লবিক। তিনি শুধু প্রতিবাদী নন তিনি ছিলেন আত্মশক্তিতে বলীয়ান মহান পুরুষ। তিনি বলেছেন আমার কর্ণধার আমি।” আত্মসত্তার শক্তির প্রতি জোর দিয়ে তিনি ধূমকেতুতে বলেছেন-
“আমি যা ভাল বুঝি;
যা সত্য বুঝি
শুধু সেটুকুই প্রকাশ করব
বলে বেড়াব।
তাতে লোকে নিন্দা যতই করুক।
আত্ম প্রবঞ্চনা করে আর আত্ম নির্যাতন ভোগ করব না।”
কবি তার দ্রোহের চেতনা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন-
“আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমা
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল ।
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল।”
নজরুল দ্রোহের চেতনার মাধ্যমে বাঙালির শতবর্ষীয় জড়তা ও আড়ষ্টতাকে ঝেড়ে ফেলে সফল ও সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন বীর সৈনিক। যুদ্ধের ভয়াবহতা, বিদেশি শাসনের গ্লানি বঙ্গভঙ্গ, খেলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে তাঁর দ্রোহের চেতনা। কবি তাঁর কবিতায় মানবতার জয় গান গেয়েছেন। সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় জীবনের বাস্তবতাকে তিনিমউপলব্ধি করেছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার কবিতায় শোষিত, অত্যাচারিত, নিপীড়িত, দরিদ্র মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা বাণীরূপ পেয়েছে। তিনি প্রবল আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে, দ্রোহের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন; মানব সেবাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি সাম্যের বাণী প্রচার করেছেন। তাঁর ভাষায়,
“গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান ।
দরিদ্র, শ্রমজীবীদের নিয়ে কবিদের নিয়ে কবি রচনা করেছেন
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাদেরই গান
তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে মহা উত্থান
উর্দ্ধে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান।”
এভাবে তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, কাজী নজরুল ইসলাম একজন যথার্থ দার্শনিক। তিনি মানুষের কথা, জীবনের কথা, জগতের কথা, স্রষ্টার কথা, নীতির কথা, দেশের কথা আমাদেরকে শুনিয়েছেন। কোলারিজ তাই বলেন, “No man was ever yet a great poet without being at the same time a profound philosopher.” নজরুলের চিন্তা চেতনা আত্মশক্তি, মানবধর্ম আমাদেরকে নতুন করে মুক্তির পথ দেখিয়েছে।