অথবা, নজরুলের দর্শনে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
অথবা, নজরুলের দর্শনে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : পৃথিবীতে অনেক দার্শনিক রয়েছেন যাদের দর্শন চিন্তা প্রকাশিত হয়েছে তাদের সাহিত্যের মধ্যে। বাঙালি ও পাশ্চাত্য দর্শনের ক্ষেত্রে এরূপ দেখা যায়। বাঙালি দার্শনিকদের দর্শন চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন কাব্যে, গানে, উপন্যাসে ও নাটকে। কাজী নজরুল ইসলামের দর্শন চিন্তাকে এভাবেই আমরা দেখতে পাই। তিনি তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে মানব চিন্তা চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বঞ্চনা প্রাপ্তি প্রভৃতিকে আঞ্চলিকতার সীমা ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিকতার পরিসরে টেনে নিয়ে এসেছেন। সমাজের সকল শ্রেণির জন্যই তিনি লেখনী ধারণ করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা বা ধর্মীয় সহিষ্ণুতা : মানবতাবাদী দার্শনিক কাজী নজরুল ইসলাম অসাম্প্রদায়িক ও পরধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন। তিনি ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, ধর্মে ধর্মে, জাতিতে জাতিতে প্রভেদ স্বীকার করেননি। নিম্নে তাঁর অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় সহিঞ্চুতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
কাজী নজরুল ইসলাম ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি ধর্মান্ধতার কাছে মাথা নত করেননি। তিনি ধর্মকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি বলেন-
“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়
কে দেয় সেখানে তালা।
চালা হাতুড়ি শাবল চালা।”
নজরুলের মতে, ধর্ম মানুষের জন্য, ধর্মের জন্য মানুষ নয়।
তিনি অন্যের ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুদের সম্পর্কে বলেন-
“নাই যার পরমত সহিষ্ণুতা সে কবু নহে ধার্মিক,
এরা রাক্ষস গোষ্ঠী, ভীষণ দৈত্যাধিক।
উৎপীড়ন যে করে, নাই তার কোনো ধর্ম ও জাতি
জ্যোতির্ময়ের আড়াল করেছে, এরা আঁধারের সাথী।”
নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ ঘটেছে তার নানা কাব্যে। তিনি হিন্দু মুসলমানদের বিভেদকে ঐক্যে পরিণত করেছেন। কাণ্ডারি হুশিয়ার কবিতায় তিনি বলেন-
“যে লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির চূড়া,
সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু দুর্গ গুঁড়া।
তিনি অসাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে পুতুলের বিয়ে কবিতায় লিখেছেন—
“মোরা এক বৃত্তে দু’টি ফুল হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তার প্রাণ।”
মূলত নজরুল ইসলাম হিন্দু মুসলমান বিরোধ চাননি। তিনি চেয়েছেন উভয়ের ঐক্য। তিনি সকল ধর্মকে কুসংস্কার মুক্ত করে তার কল্যাণময়ী রূপ উন্মোচন করতে গিয়ে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী দর্শন রচনা করেছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, অসাম্প্রদায়িক ধ্যানধারণার অধিকারী কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি দর্শনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন পর ধর্ম, পরমতসহিষ্ণু। তার কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাসে তাঁর অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। তার দর্শনের মূল সূত্র সংহতি, ঐক্য পরধর্ম সহিষ্ণুতা। তার মানবতাবাদ অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ।