অথবা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী? ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা কর।
অথবা, লর্ড কর্ণওয়ালিস এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সবিস্তারে আলোচনা কর।
অথবা, কর্ণওয়ালিস-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে তুমি যা জান তা লিখ।
উত্তর ভূমিকা : ১৭৬৫ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় দেওয়ানি অধিকার লাভ করেন।
কোম্পানির দেওয়ানি লাভ করার ফলে একদিকে কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন, অন্যদিকে কতিপয় কর্মচারীর দুর্নীতির জন্য বাংলার ভাগ্যাকাশে নেমে আসে কালের করাল গ্রাস। তাই সংঘটিত হয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। ফলে ব্রিটিশ সরকার সবগুলোর জন্য কোম্পানিকে দায়ী করেন এবং ভারতবর্ষে নতুন একজন গভর্নর জেনারেল হিসেবে ওয়ারেন হেস্টিংসকে পাঠান। হেস্টিংসের শাসনামলে প্রথম রেগুলেটিং এ্যাক্ট পাস করা হয়, যা যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। তেমনি ওয়ারেন হেস্টিংস এর পর ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন (১৭৮৬) লর্ড কর্নওয়ালিস। এ কর্নওয়ালিসের শাসনামলেই পূর্বের অনেক আলোচনা সমালোচনার পর ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা করা হয়। এ চিরস্থায়ী
বন্দোবস্তকে বলা হয় দীর্ঘ দু দশকের সাধারণ জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে উচ্চতম কর্মকর্তা, ডাইরেক্টর সভা, পার্লামেন্ট তাত্ত্বির, অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিকের চেতনার ফসল।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলো কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য জমিদারদের সাথে সম্পাদিত একটি চুক্তি সমতুল্য ব্যবস্থা। ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক এটা ঘোষিত হয়। কিন্তু আইডিয়া হিসেবে এ বন্দোবস্ত কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞ মহলে আলোচিত হতে থাকে প্রায় দুদশক আগে থেকেই। বিমূর্তভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইডিয়া প্রথম দেন সমকালীন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ/ অর্থনীতিবিদ আলেকজান্ডার দাও ও হেনরি পেটুল্লো। দাও-পেটুল্লো প্রদত্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইডিয়া থেকে প্রথম বিমূর্ত রূপ দেন কাউন্সিলর ফিলিপ ফ্রান্সিস। কিন্তু ফিলিপ ফ্রান্সিসের বন্দোবস্তের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। তবে অনেকটা ব্রিটিশ
সরকারকে ভূমি রাজস্ব সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। ফিলিপ ফ্রান্সিসের পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে পরে ব্রিটিশ সরকার ১৭৮৪ সালে ‘Pitt India Acts’ পাস করেন। এ ‘Pitt India Acts’-এর ৩৯নং ধারায় রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছিল। ‘Pitt India Acts’ পাস হওয়ার পর কাউন্সিলর চার্লস স্টুয়ার্ট প্রথম দিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন এবং ‘Pitt India Acts’-এর ৩৯নং ধারা মোতাবেক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এ সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই দেখা যায়, চার্লস স্টুয়ার্টের পরিকল্পনা প্রশংসিত হলেও তা কার্যকরী করা সম্ভব ছিল না। কারণ, গভর্নর জেনারেলের পরিকল্পনা কার্যকরী না করে কাউন্সিলের পরিকল্পনা কার্যকরী করার কোন পরিবেশ ছিল না। তাই তা ব্যর্থ হয়। কিন্তু চার্লস স্টুয়ার্টের পরিকল্পনার মধ্যে ব্রিটিশ সরকার রাজস্ব সমস্যা সমাধানের আভাস পান।
চার্লস স্টুয়ার্টের পরিকল্পনার কিছুদিন পরে কোম্পানি দেখলেন যে, ভারতে কোম্পানির রাজস্ব নিয়ে যে সমস্যা তা সমাধান করার একমাত্র উপায় হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রবর্তন করার মাধ্যমে রাজস্ব সমস্যা সমাধান করা। তাই ১৭৮৬ সালে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে পাঠান। কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে এসেই রাজস্ব সমস্যা সমাধানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা কার্যকরী করার জন্য জোর তৎপরতা শুরু করেন। কিন্তু এ কার্যে তাঁর কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ান তাঁর রাজস্ব উপদেষ্টা ও বোর্ড অবরেভিনিউর প্রেসিডেন্ট জন শোর। জন শোর মতামত ব্যক্ত করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার পূর্বে জানা দরকার :
১.জমিদার, তালুকদার ও রায়তের বর্তমান আর্থিক অবস্থা।
২.মুঘল শক্তির অবক্ষয়ের আগে জমিদার ও রায়তের অধিকার।
৩.মুঘল শক্তির পতন পর্বে রায়তের খাজনা সংক্রান্ত আইন।
8.দেওয়ানি লাভের পর জমিদার কর্তৃক আরোপিত নতুন আবওয়াব, মামথ ইত্যাদি।
সাধারণ রায়তের স্বার্থরক্ষার উপায়।
৬.বর্তমান রাজস্ব ধার্য ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ দূর করার উপায় ।
৭.১৭৭২ সাল থেকে প্রত্যেক জমিদারির বিস্তারিত জমা, উশুল ও বাকি হিসাব সংগ্রহ।
জন শোরের মতানৈক্যের জন্য কর্নওয়ালিসের পরিকল্পনা কার্যকরী করা সম্ভব হলো না। এছাড়া ঐ সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার ক্ষেত্রে দুটি সমস্যাও ছিল। যথা : ১. নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব, ২. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সরকারি বিশেষজ্ঞ মহলে ঘোরতর মতানৈক্য। এ ধরনের পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বোর্ড অব রেভিনিউ এর প্রেসিডেন্ট জন শোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিবর্তে আপাতত এক বা দুদশকের জন্য একটি পরীক্ষামূলক বন্দোবস্ত করার পক্ষে জোরালো যুক্তি প্রদর্শন করেন। তাই ১৭৯০ সালে দশসালা বন্দোবস্ত করা হয়। এ শর্তে বলা হয় যে, কোর্ট অব ডাইরেক্টরস তৎক্ষণাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পক্ষে মতামত প্রকাশ করলে দশসালা বন্দোবস্তকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা করা হবে। তাই ১৯৯২ সালের শেষের দিকে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পক্ষে মতামত দিলে কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা করেন। ফলে রাজস্ব সমস্যা নিয়ে যে দুদশকের আলোচনা পর্যালোচনা তার অবসান হয়। তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কর্নওয়ালিসের শাসনামলে প্রবর্তিত হলেও এককভাবে তাঁর কৃতিত্ব ছিল বলা যায় না। এক্ষেত্রে দুদশক ধরে সাধারণ জেলা প্রশাসক, আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিক, পার্লামেন্ট ও কোর্ট অব ডাইরেক্টরস সভার অবদান ছিল। কর্নওয়ালিস এসবের মধ্যে সমন্বয় করেন মাত্র।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনয়নকারী যে পদক্ষেপটি ভারতের তদানীন্তন গভর্নর লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ ঘোষিত আইন দ্বারা বলবৎ করেন তাই-ই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। জমির মালিকানা, খাজনা প্রভৃতি কতকগুলো বিষয় এই আইনের ‘চিরস্থায়ীভাবে’ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল বলেই একে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে অভিহিত করা হয়।