উত্তর : প্রতিভাবান সাহিত্যিক শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) বাংলাদেশের প্রধান কবি। তিনি ছিলেন রাজনীতি ও সমাজ সচেতন মানুষ। এদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন ও উত্থানপতন তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রতিটি আন্দোলনের সাথে তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ। অত্যন্ত কাছে থেকে তিনি আন্দোলনসমূহ পর্যবেক্ষণ করেছেন। বার বার ফিরে আসে’ কবিতায় কবি কান্তিক ভাষায় এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনকে চিত্রিত করেছেন। বারবার ফিরে আসে আন্দোলনের স্মৃতি। কবি কবিতা লিখতে গিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ঘটনাবলির। তিনি বলেছেন-
“বার বার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে হাতে,
মিছিলে পতাকা হয় বার বার রক্তাপ্লুত শার্
দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বার বার,
বার বার কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।”
এই রক্তাপুভ শার্ট ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ অকুতোভয় আসাদের রক্তমাখা শার্ট। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল এদেশের মানুষ। রাজবন্দী শেখ মুজিবরের মুক্তির দাবিতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯। এদিন মারমুখী জনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য বর্বর পাকবাহিনী গুলি চালিয়েছিল জনতার মিছিলে। পুলিশের গুলিতে সেদিন নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন আসাদ। কিন্তু জনতার আন্দোলন থামেনি। আসাদের রক্তমাখা শার্টকে পতাকা বানিয়ে জনতার সেই মিছিল আরো বেগবান ও জঙ্গি হয়ে উঠেছিল। রক্তমাখা শার্ট দেখে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে শরিক হয়েছিল আন্দোলনে। ২৪ জানুয়ারি সংঘটিত হলো গণঅভ্যুত্থান। স্বৈরাচার সরকার বাধ্য হয়েছিল পিছু হটতে। তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি আন্দোলন। ১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল স্বৈরাচারী শাসকদের অপশাসনের কারণে তা দিন দিন নতুন মাত্রা পেয়েছিল। আর এ সকল স্বাধিকার আন্দোলনের প্রত্যেকটিতে অগণন মানুষকে ওরা
হত্যা করেছিল। কবি তাই বলেছেন-
“আমাকেই হত্যা করে ওরা বায়ান্নোর রৌদ্রময় পথে,
আমাকেই হত্যা করে ওরা,
ঊনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে,
একাত্তরে পুনরায় হত্যা করে ওরা আমাকেই
আমাকেই হত্যা করে ওরা
পথের কিনারে এভেন্যুর মোড়ে মিছিলে, সভায়-
আমাকেই হত্যা করে, ওরা হত্যা করে বার বার।”
এ সকল আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয় মুক্তিযুদ্ধ। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ নামের নতুন দেশ। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কত গৃহবধূকে যে বিধবা হতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কবি বলেছেন-
“একটি বধুর সংসার উজাড় করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ খাঁ গোরস্থান হয়ে যায়।”
এ সকল আন্দোলন সফল করতে কত মা যে তাঁর সন্তান হারিয়েছেন তার হিসাব নেই। কবি এই সন্তান হারানোর কথাটাই কাব্যিক ভাষায় বলেছেন-
“একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোর আকাশ হয়ে যায়”।
স্বাধিকার আন্দোলনের এই সংগ্রামকে সার্থক করতে গিয়ে কত পিতার বুক যে খালি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কবি কাব্যিক ভাষায় বলেছেন-
“একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
ঝরে পড়তে না পড়তেই
আরেক পিতার বুক শূন্য করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
নেমে যায় নীরদ্ধ অন্ধকারে।)
এভাবে গৃহবধূদের বৈধব্য, মায়েদের কান্না, পিতাদের হাহাকারের বিনিময়ে এদেশের প্রত্যেকটি স্বাধিকার আন্দোলন সফল হয়েছে। শত্রুরা বার বার আমাদের গলাটিপে হত্যা করতে চেয়েছে। আর বার বার শহীদের রক্তাপ্লুত শার্ট পতাকা হয়ে আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আমাদের স্বাধিকার আদায়ে আত্মোৎসর্গকারীদের জীবন বিসর্জনের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলনের জন্য আত্মত্যাগকারীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, আর তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন শহীদ মিনার। কবির প্রশ্ন-
“তবে কি আমার
বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হয়ে যাবে?”
পরিশেষে বলা যায় যে, জনগণের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে যারা জীবন উৎসর্গ করে তারা পরবর্তী প্রজন্মের আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে থাকে। তাদের ত্যাগের অনুপ্রেরণা বুকে নিয়ে জাতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে। শহীদের রক্তমাখা শার্ট হয়ে উঠে সংগ্রামের বিজয় কেতন। এভাবেই যুগ থেকে যুগান্তরে আন্দোলনের বহ্নিশিখা আলো ছড়িয়ে দেয়। শহীদদের স্মৃতি বার বার জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে জাতির মনে।