উত্তর ভূমিকা : গুরু নানক ও কবিরের মূল দর্শন ও উদ্দেশ্য এক ছিল। তাদের উভয়ের উদ্দেশ্যই ছিল হিন্দু-মুসলিম, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে এক ছায়াতলে এনে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এক কথায় বিভিন্ন ধর্ম-জাতি- বর্ণের বিভাজন রেখা অতিক্রম করে এক ঈশ্বরের প্রেমে মগ্ন থাকা। কিছু বিষয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকতে পারে, তবে মূল বিষয়ে তারা এক।
→ কবির ও নানকের দর্শনের তুলনা : নিম্নে কবির ও গুরু নানকের দর্শনের তুলনামূলক মূল্যায়ন তুলে ধরা হলো :
১. একেশ্বরবাদ : কবির ও নানক উভয়েই সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের একত্বে বিশ্বাস করতেন। কবির তার ঈশ্বরকে রাম, হরি, গোবিন্দ ব্রাহ্ম, আল্লাহ, খোদা প্রভৃতি নামে ডাকতেন এবং নানক ঈশ্বরকে রামা, গোবিন্দ, হরি, মুড়রি, রব, রহিম প্রভৃতি নামে ডাকতেন।
২. হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: কবির ও নানক উভয়েই হিন্দু- মুসলিম ঐক্য সারণের চিন্তা করতেন। কবির এই দুই ধর্মের লক্ষ্য বিরোধী বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উন্নতিতে গুরুত্ব
নেই এমন বিষয় বর্জন করেছেন।
৩. মানবতার সাম্য : কবির ও নানক উভয় –এর দর্শন চিন্তার মূল বক্তব্য ছিল সকল মানুষ সমান। হিন্দু-মুসলিম বলতে যেমন কিছু
নেই তেমন বর্ণভিত্তিক কারো প্রাধান্য নেই। সবাই এক ঈশ্বরের এবং রক্তের সৃষ্টি। এভাবে হিন্দুদের বর্ণ প্রথার বিরোধিতা ও উভয়
সম্প্রদায়ের মাঝে ঐক্য সৃষ্টির প্রয়াস ছিল দুজনের দর্শনেই ।
৪. গুরুতত্ত্ব : কবির ও নানক উভয়েই মনে করতেন ঈশ্বরের প্রতি আত্মার অভিযাত্রায় গুরুর নির্দেশ প্রয়োজন। এ সম্পর্কে কবির
বলেছেন, “গুরু হৃদয়কে কালিমামুক্ত করে। যাদের গুরু নেই, তারা নিষ্ফল হবে। তাই গুরু নির্বাচনে সতর্কর্তা আবশ্যক।” নানকের মতে,
গুরুই শিষ্যকে পথনির্দেশ করে। এই পথনির্দেশের চারটি পর্যায় আছে।
যথা- ১. শরণ খণ্ড; ২. জ্ঞান খণ্ড; ৩. করম খণ্ড; ও ৪. সচ খণ্ড।
৫. বৈরাগ্যবাদ : কবির বৈরাগ্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। আবার, নানক সংসার ও চাকরি ত্যাগ করে ভ্রমণ করে বেড়ান। কবির নিজেই তাঁত বুনতেন। তবে উভয়েই.চরম কৃচ্ছসাধন বা জগৎ বিচ্ছিন্নতাকে সমর্থন করতেন না।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগীয় ভারতের ভক্তি আন্দোলনের ইতিহাসের প্রধান দুই পুরোধাই ছিলেন কবির ও নানক। ঈশ্বর প্রেম ও সামাজিক সাম্যের বাণী নিয়ে তাদের
দর্শন বর্ণ প্রথার বেড়াজালে অতিষ্ঠ নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ।