ঐতিহাসিক ছয়দফা উল্লেখপূর্বক এর যৌক্তিকতা বিচার কর।

অথবা, ঐতিহাসিক ছয়দফা উল্লেখপূর্বক এর যৌক্তিকতা মূল্যায়ন কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক শাসকচক্রের অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক আধিপত্যে পূর্ব বাংলার জনগণ যখন ক্ষুব্ধ হয়, তখন ১৯৫৬ সালে ভারত-পাকিস্তানে সংঘটিত হয় ১৭ দিন ব্যাপী এক ভয়াবহ যুদ্ধ। এ যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলা পাকিস্তান তথা বহির্বিশ্ব হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, অরক্ষিত ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এ পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবি হিসেবে ঐতিহাসিক ছয়দফা প্রস্তাব করেন।
ছয়দফা দাবির উদ্ভব : পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালিদের উপর শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শোষক চক্রের শোষণ ও নির্যাতন। পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলে বৈষম্য। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠে৷ পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাঁচামালের যোগানদাতা অঞ্চল ও উপনিবেশ। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে পূর্ব বাংলা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এতে পূর্ব বাংলার জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি
তাসখন্দ চুক্তি, ভারত ও পাকিস্তান এর মধ্যে হলে পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ১৯৬৬ সালের ৫-৬ তারিখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজামে ইসলামী দলের নেতা মোহাম্মদ আলীর লাহোরস্থ বাসভবনে সম্মেলন শুরু করেন। মোহাম্মদ আলী বলেন বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করা যুক্তিযুক্ত হবে না। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন।
ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবির কর্মসূচি :
প্রথম দফা শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি : ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। প্রদেশগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এ যুক্তরাষ্ট্রের সরকার হবে সংসদীয় প্রকৃতির। আইন পরিষদ হবে সার্বভৌম। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক
আইনসভাগুলো গঠিত হবে।
দ্বিতীয় দফা কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা : কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে থাকবে কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে প্রদেশ বা অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
। তৃতীয় দফা মুদ্রা বা অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতা :
ক. সমগ্র দেশের দুই অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
খ. সমগ্র দেশের দুই অঞ্চলের জন্য কেবল একটি মুদ্রাই চালু থাকবে। তবে সেক্ষেত্রে সংবিধান এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে করে এক অঞ্চলের মুদ্রা’ ও মূলধন অন্য অঞ্চলে পাচার হতে না পারে। এক্ষেত্রে পূর্ব
পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ এবং পৃথক অর্থ বিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
চতুর্থ দফা রাজস্ব কর ও শুল্কসংক্রান্ত ক্ষমতা : যুক্তরাষ্ট্রের প্রদেশে বা রাজ্যগুলোর খাজনা, কর বা শুল্ক ধার্যের ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ খাজনা, ট্যাক্স ও কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রদেশ বা অঙ্গরাষ্ট্রীয় সরকারের আদায়কৃত রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয়
সরকারের প্রাপ্য হবে। প্রদেশ বা অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর সরকারের আদায়কৃত করের নির্ধারিত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের
তহবিল গঠিত হবে।
পঞ্চম দফা বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা :
১. পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রদেশের বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসাব।
২. কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে প্রদেশ মিটাবে।
৩. প্রদেশ বা অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দেশজ দ্রব্যাদি চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোন বাধানিষেধ থাকবে না।
৪. সংবিধানে প্রদেশকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং নিজ নিজ স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
৫. বৈদেশিক মুদ্রার এখতিয়ার প্রদেশগুলোর হাতে থাকবে।
ষষ্ঠদফা : আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা : আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সংবিধানে
প্রদেশ বা অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীন আধাসামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
ছয়দফার যৌক্তিকতা : বাস্তবিক পক্ষে ছয়দফার মাধ্যমে বাঙালি পাক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো ঐক্যবদ্ধ
সংগ্রাম চালায়, যার Legitimacy পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে প্রকাশ পাই। মূলত বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের First
platfrom তৈরি হয় এখান থেকে। নিচে এর যৌক্তিকতা তুলে ধরা হলো :
১. স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠা : আইয়ুব শাসনামলেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে জনগণের কোন অধিকার ছিল না। মূলত পাকিস্তানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানি স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবির ক্ষেত্রে ছয়দফা ছিল প্রথম লিখিত দলিল বা সাক্ষ্য বিশেষ। সব দমন নীতি বুমেরাং হয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিকেই বহুগুণে জোরদার করেছিল।
২. অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা : “The economic disparity of Fast Pakistan during the Auyub Regime was so at the high level of it’s disparity.” [R. Jahan-Pakistan Jwihere in national integrity] পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ শিল্পকারখানা, বাণিজ্য সংস্থা, ব্যাংক ও বিমা পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিয়ন্ত্রণ করতো। আর
বাস্তব পক্ষে ছয়দফা ছিল তৎকালীন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থার বর্ণনা।
৩. বাঙালিদের বাঁচার দাবি : “Six point demand was the demand for the servival of the Bengalies.” ছয়দফার মূল প্রবক্তা শেখ মুজিবুর রহমান একে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করে সাংবিধানিক উপায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন।
৪. জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা : পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব ও বৈষম্য থাকায় সাধারণ জনগণের অধিকার রক্ষিত হচ্ছিল না। আর ছয়দফা ছিল মূলত জনগণের প্রাণের দাবি।
৫. ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের কাঁচামালের উর্বর ভূমি হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাঁচামাল নিয়ে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পকারখানা গড়ে তোলে। পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যের অগ্রগতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এর ছয়দফা মূলত এক দলিলস্বরূপ যা জনগণকে প্রেরণা যুগিয়েছে পশ্চিমা শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ।
৬. জাতীয়তাবোধের উন্মেষ : ছয়দফা দাবি ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার এক মূর্তপ্রতীক। এর প্রতি
তাদের সমর্থন দিন স্বতঃস্ফূর্ত। বাংলার জনগণের মনে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে ছয়দফার গুরুত্ব ছিল
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
৭. মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা : ছয়দফা দাবির মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হয় এতে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এছাড়া মুদ্রা ব্যবস্থা ও অন্যান্য দাবি পূর্ব বাংলার জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করে।
৮. মুক্তির সনদ : ছয়দফার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বলেছিলেন, “ছয়দফা বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ এবং বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার গ্যারান্টি।”
৯. অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : আওয়ামী লীগের ছয়দফা ছিল মূলত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ন্যায়ের পক্ষে সমর্থন করা। আইয়ুব শাসনামলে পাকিস্তানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিভেদ, পার্থক্য ও অন্যায় অবিচার ক্রমবর্ধমান গতিতে চলছিল তার বিরুদ্ধে ছয়দফা ছিল এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।
১০. স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা : বলাবাহুল্য যে, ছয়দফাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। আর স্বাধীনতা আন্দোলনও তা অর্জনের মধ্য দিয়ে ছয়দফা ঐতিহাসিক মর্যাদা পেল। British গণতন্ত্রের৷ ইতিহাসে যেমন- ‘ম্যাগনাকার্টা’ ও অধিকার বিল, USA, স্বাধিকার আন্দোলনের ফল গণতন্ত্র তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি হচ্ছে আওয়ামী লীগের ছয়দফা কর্মসূচি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫২ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বীজবপন হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ৬ দফার মাধ্যমে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ৬ দফা আন্দোলনকে অনেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলনে হিসেবে অভিহিত করলেও মূলত এটা ছিল সমগ্র বাঙালির মুক্তির দাবি, যার চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে ১৯৭১ সালে মুক্তিসংগ্রামে। অন্য কথায় ৬ দফা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল ধর্ম-বর্ণ শ্রেণি নির্বিশেষে বাঙালি জনগণকে জাতীয় মুক্তির চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা।