ঐকতান’ কবিতায় বিধৃত রবীন্দ্রনাথের জগৎ ও জীবনবোধের স্বরূপ আলোচনা কর।

উত্তর ভুমিকা : জীবন সায়াহ্নে উপনীত হয়ে রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) আপন মানসলোকে তাঁর সাহিত্যে জীবনের প্রতিফলন দেখেছেন। তিনি প্রজ্ঞার আলোকে আপনার সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন করে অনও সাহিত্য সভায় এর সীমাবদ্ধতা নির্ণয় করেছেন। এ কবিতাটি কবির আত্মমূল্যায়নেরও দলিল বটে।
‘ঐকতান’ এর জগৎ ও জীবনবোধ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজীবন যে কাব্য সাধনা করেছেন তাতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি তাঁর সুধা সর্বত্র পৌঁছে দিতে না পারার এ জন্য আক্ষেপ করেছেন। কবি সুদীর্ঘ জীবন ধরে প্রেম, রোমান্টিকতা, প্রকৃতি ও অধ্যাত্মের মধ্যে বসে যা রচনা করেছেন, তার সঙ্গে সাধারণ জীবনের কোন সংযোগ নেই। তাই নবীন কবিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন-

‘আমার কবিতা, জানি আমি,
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী)


কবির বিশ্বভাবনা :
কবিরা সর্বদা বিশ্বলোকে বিচরণ করেন। সমগ্র বিশ্বের সভ্যতা, সমাজ বাস্তবতা ও প্রকৃতি ভাবনা কবি হৃদয়ে চির ভাস্বর। কবি বিচরণ করেন মেরু থেকে মেরু পর্যন্ত। কবি কল্পনায় বিশ্বায়ত জীবনবোধ জাগ্রত হয়েছে। সমগ্র বিশ্বজগতের ঐকতানে কবি হৃদয় আন্দোলিত হয়ে উঠেছে-

কল্পনায় অনুমানে ধরিত্রীর মহা ঐকতান
কত না নিস্তব্ধক্ষণে পূর্ণ করিয়াছে মোর প্রাণ’।

প্রকৃতির অনাবিল ঐক্য: কবি লক্ষ করেছেন, সমগ্র বিশ্বলোক অনিবার্য এক ঐক্যসূত্রে গাঁথা। কবির পক্ষে সমগ্র বিশ্ব পরিভ্রমণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু যতটুকু দেখেছেন, তার মধ্য থেকে গ্রহ, নক্ষত্র, তারকারাজি ও অসীম তুষার শুভ্রতার মধ্যে ঐক্য অনুভব করেছেন। মহাকাল পর্যন্ত এ ঐক্য বিরাজমান। এ ঐক্যের আহবানে কবি বলেছেন-

. ‘প্রকৃতির ঐকতান স্রোতে
নানা কবি ঢালে গান নানা দিক হতে।’)

মানবতার ঐক্য : এ বিশ্বলোকে নানা বর্ণের মানুষ বিরাজমান। বিশ্বলোকের সবাই সুন্দরের পূজারী। কিন্তু জাতি, বর্ণ, ধনী ও গরিবের শ্রেণি বৈষম্যের কারণে অশান্ত এ ধরণী। মানুষের শরীরসত্তার অন্তরালে যে সত্তাটি রয়েছে তাকে আমরা মন বলে জানি। মনকে জানতে হলে, বুঝতে হলে, মন দিয়ে তা সম্ভব। মানব মনের এ ঐক্য সম্পর্কে কবি বলেছেন-


সবচেয়ে দুর্গম যে মানুষ আপন অন্তরালে,
তার কোন পরিমাপ নাই বাহিরের দেশে কালে।’


ক্য স্থাপনের ক্ষেত্রে বাধা : মন এক ও অভিন্ন। কিন্তু শ্রেণিগত পার্থক্যের কারণে ঐক্য স্থাপিত হয় না। ধনী, গরিব যে শ্রেণি বৈষম্য তা সমাজ সচেতনভাবে দূর করতে দেয় না। সমাজ সংসারে যারা খেটে খায়, তাদের খবর কেউ রাখে না। তাদের পরিশ্রমের উপকরণ দিয়ে মানব সংসার সচল রয়েছে। কিন্তু তারা অবহেলিত। এমন কি কবি নিজেও তাদের খোঁজ খবর রাখেননি। কবির সাথে তাদের আত্মিক মিলন সম্ভব হয়নি।
কবির মানব প্রেমের ধারা : কবি বার্ধক্যে এসে দারিদ্র্যক্লিষ্ট সাধারণ মানুষের প্রেমে মুগ্ধ হয়েছেন। রোমান্টিকতা ও প্রেম ভালোবাসায় মুগ্ধ কৰি জীর্ণ কুটিরে প্রবেশ করেছেন। নিজের ভালোবাসা দিয়ে তাদেরকে সিক্ত করতে চেয়েছেন। মৃত্তিকাধনিষ্ঠ মানুষের জন্য যা করতে পারেননি, তার জন্য নবীন কবিদের উদ্দেশ্যে বলেছেন-


‘যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।’

সাধারণের সম্মান : জীবন সংসারে সাধারণ মানুষের অবস্থান বেশি। সমাজ সংসারে উল্লেখযোগ্য কর্মগুলো তারাই সম্পাদন করে থাকে। কিন্তু তাদের কেউ স্বীকৃতি দেয় না। তারা স্বীকৃতিহীন অবস্থায় সমাজে বসবাস করে। নিভৃতচারী এ সাধারণ মানুষের প্রতি কবি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন-

‘সাহিত্যের ঐকতান সংগীত সভায়
‘একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়’


কবির শ্রদ্ধা নিবেদন : ‘ঐকতান’ কবিতায় কবি অতিসাধারণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তিনি অখ্যাত আউল বাউলদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। কারণ তাঁরা সাধারণকে আনন্দদানে সর্বদা সচেষ্ট। সেই আউল বাউল কবিদের প্রতি সহস্রবার নমস্কার জানিয়ে তিনি বলেছেন-


৷ “আমি বারংবার
তোমারে করিব নমস্কার।’)

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, কবির শেষ জীবনের রচনায় জীবনের প্রতি যে মমত্ববোধ জাগ্রত হয়েছে তা অনস্বীকার্য। আন্তরিক প্রীতির সমস্ত বন্ধন যে পেছনে ফেলে রেখে যেতে হচ্ছে তার জন্য স্বাভাবিকভাবেই বেদনা অনুভব করেছেন কবি।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%90%e0%a6%95%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a5-2/