অথবা, সমালোচনাসহ এ্যাডাম স্মিথের অর্থনীতির সংজ্ঞাটি ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: প্রারন্তিক কথা: ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা চিন্তার নায়ক অর্থনীতির জনক এ্যাডাম স্মিথ সর্বপ্রথম পৃথক শাস্ত্র হিসেবে অর্থশাস্ত্রের আলোচনা করেন এবং এর সংজ্ঞা নির্ধারণে প্রয়াসী হন। ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর সুবিখ্যাত ‘An Enquiry into The Nature and Causes of wealth of nations’ নামক গ্রন্থে অর্থনীতিকে ‘সম্পদের বিজ্ঞান’ হিসেবে অভিহিত করে অর্থনীতির সংজ্ঞা প্রদান করেন।।
এ্যাডাম স্মিথের সংজ্ঞা: অর্থনৈতিক অঙ্গনে তাঁর আর্বিভাবের পূর্বে অর্থনীতিকে পৃথক বিষয় হিসেবে গণ্য করা হত না। অর্থনীতিকে তখন বলা হত রাজনৈতিক অর্থনীতি। কিন্তু এ্যাডাম স্মিথই প্রথমে রাষ্ট্রনীতি হতে অর্থনীতিকে পৃথক করে একটি স্বতন্ত্র বিষয়ের মর্যাদা দিলেন। এ জন্য তাঁকে অর্থনীতির জনক বলা হয়। ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর
“Wealth of Nations” গ্রন্থে এ্যাডাম স্মিথ বলেন, “অর্থনীতি জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি ও কারণ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে।” সমার্থক। এ্যাডাম স্মিথের এই ধারণা পরবর্তীকালে জে.বি. সে. ওয়াকার, জন স্টুয়ার্ট মিল, প্রমুখ ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণ সমর্থন করেন।
এ্যাডাম স্মিথের সংজ্ঞার সমালোচনা: এ্যাডাম স্মিথ ও তাঁর অনামী চাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণের এই ধারণা বেশ কিছুকাল প্রচলিত থাকলেও অচিরেই এটি বিরূপ সমানে চনার সন্ন্ধু ৭২৯। কারণ উনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিকদের রুচিবোধ এই সংজ্ঞাকে মানুষের স্বাভাবিক কার্যাবলির প্রকৃত ব্যাখ্যা বলে গ্রহণ করতে পারেনি। তাই তাঁরা এই শাত্রকে স্থূল ও অর্থপূক্রতার প্রজাতন্ত্র বলে উপহাস করেছে। চিন্তার নায়ক কার্লাইল ও রাস্কিন অর্থশাস্ত্রকে ‘যক্ষের বাণী, বর্ণ সংকর বিজ্ঞান ইত্যাদি তীব্র নিন্দাসূচক আখ্যায় ভূষিত করেন। নিম্নে তাঁর সংজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা গুলো নিম্নরূপ-
১. সংজ্ঞাটি অসম্পূর্ণ: এ্যাডাম স্মিথের সংজ্ঞা সবগুলোই অসম্পূর্ণ। অর্থশাস্ত্র মানুষের সীমাহীন অভাবকে সীমিত সম্পদের সাহায্যে মিটানোর পথ নির্দেশ করে কিন্তু স্মিথের সংজ্ঞায় এই বিষয়ের কোন উল্লেখ নেই। অতএব বলা যায় এই সংজ্ঞা অর্থশাস্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে ব্যর্থ হয়েছে।
২. সম্পদের সঠিক ব্যাখ্যার অভাবঃ এ্যাডাম স্মিথের সংজ্ঞায় সম্পদের সঠিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। তিনি সম্পদ বলতে শুধু সত্তগত দ্রব্যকেই বুঝিয়েছেন কিন্তু অর্থনীতিতে সম্পদ বলতে বস্তুগত ও অবস্তুগত সব দ্রব্যকেই বুঝায়- যেগুলোর বিনিময় মূল্য আছে এবং মানুষের অভাব সেটাতে সক্ষম। সুতরাং সম্পদের সঠিক ব্যাখ্যার অভাবে সংজ্ঞাটি সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে।
৩. সম্পদের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ: এ সংজ্ঞায় সম্পদের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করার ফলে উনবিংশ শতাব্দীর চিন্তাবিদ কার্লাইল ও রাস্কিন অর্থনীতিকে “যক্ষের বাণী” বা বর্ণ সংকর বিজ্ঞান ইত্যাদি নিন্দাসূচক ভাষায় ভূষিত করেছেন। তাঁদের মতে সম্পদ আহরণ অর্থনীতির একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয় হলে এ শাস্ত্র মানুষকে স্বার্থপর, নীচু ও অর্থলোলুপ করে তুলতে বাধ্য। সুতরাং সম্পদের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করায় অর্থনীতি একটি স্বার্থপর বিজ্ঞানে, বিমর্ষ বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে।
৪. মানব কল্যাণের অনুপস্থিতিঃ এ্যাডাম স্মিথ এবং তাঁর অনুসারীরা মানব কল্যাণের চেয়ে সম্পদের উপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করেন। তাই স্মিথের সংজ্ঞায় সম্পদ আহরণ মুখ্য এবং কল্যাণ গৌণ। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সম্পদ আহরণের মূখ্য উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ সাধন করা। তাঁর সংজ্ঞায় কল্যাণের দিকটি উপেক্ষিত হয়েছে।
৫. সম্পদ আহরণের ব্যাখ্যা নেই: স্মিথের সংজ্ঞায় সম্পদ আহরণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কি উপায়ে সম্পদ আহরণ করা হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। কারণ, অবৈধ উপায়ে বা বিনা পরিশ্রমে আহরিত সম্পদ অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় হতে পারে না।
৬. মানব-আচরণ আলোচনায় আসেনিঃ তাঁর সংজ্ঞায় সম্পদ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। কিন্তু সম্পদ যাদের জন্য সৃষ্টি করা হয় তাদের সম্পর্কে একেবারেই নীরব। সম্পদ মানুষের জন্য সৃষ্টি হয় অথচ মানুষের আচরণ সর্ম্পকে এ্যাডাম স্মিথের সংজ্ঞায় কিছুই বলা হয়নি।
৭. অর্থশাস্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ উৎঘাটিত হয়নি: অর্থনীতির প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে এ্যাডাম স্মিথ ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ মানুষ অসীম অভাবের সম্মুখীন। কিন্তু অভাব পূরনোপযোগী সম্পদ মারাত্বকভাবে সীমাবদ্ধ। এ অসীম অভাব এবং সসীম সম্পদের মধ্যে কিভাবে সামঞ্জস্য বিধান করা যায় অর্থনীতিতে এর নির্দেশ থাকবে। অথচ এ্যাডাম স্মিথের সংজ্ঞায় এরূপ পথ নির্দেশের কোন ইঙ্গিত নেই।
উপসংহার: উপরিউক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, এ্যাডাম স্মিথের সংজ্ঞায় অর্থনীতির প্রকৃত রূপ প্রকাশ না পেলেও তাঁর সংজ্ঞার গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কেননা, তিনি প্রথম রাষ্ট্রনীতি ও অন্যান্য বিষয় থেকে অর্থনীতিকে একটি পৃথক বিষয় বা নিয়মতান্ত্রিক বিজ্ঞান হিসেবে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেন।