অথবা,এককেন্দ্রিক সরকার কী? এককেন্দ্রিক সরকারের বিশেষত্ব আলোচনা কর।
অথবা, এককেন্দ্রিক সরকার কাকে বলে। এককেন্দ্রিক সরকারের গ্রন্থটি উল্লেখ কর।
উত্তর: ভূমিকা : “Unitarism is the habitual exercise of supreme legislative authority by one central power.”
এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের মাধ্যমে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে নাও থাকে। এককেন্দ্রিক সরকারে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকারসমূহকে ক্ষমতা অর্পণ করে থাকে। আঞ্চলিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট মাত্র। গ্রেট ব্রিটেন, ইতালি, ফ্রান্স, জাপান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে এককেন্দ্রিক শাসন প্রচলিত আছে।
এককেন্দ্রিক সরকার : সাধারণভাবে বলা যায়, যে শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের মাধ্যমে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রের
প্রাদেশিক সরকারের এক্ষেত্রে কোন এখতিয়ার নেই।হাতে নাস্ত থাকে, তাকে এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা বলা হয়। রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কেন্দ্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: এককেন্দ্রিক সরকারের ধরন ও প্রকৃতির উপর দৃষ্টি রেখে সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ একে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো : সংবিধান বিশেষজ্ঞ সি. এফ. স্ট্রং (CF Strong) বলেছেন, “এককেন্দ্রিক সরকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কেন্দ্রীয় সরকার অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা ভোগ করে, কারণ সংবিধান কেন্দ্রীয় আইনসভা ব্যতীত অপর কোন আইন প্রণয়নকারী সংস্থাকেএকটি ইউটারি স্টেটের সারমর্ম হল যে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ নয় কারণ সংবিধান তাদের কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়া অন্য কোনো প্রণয়ন সংস্থাকে স্বীকার করে না।
অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner) বলেন, “যেখানে সকল ক্ষমতা শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয় এবং স্থানীয় সরকারসমূহের ক্ষমতা, স্বাতন্ত্র্য এমনকি অস্তিত্ব ও ঐ কেন্দ্রীয় সরকারের উপরই নির্ভরশীল তাকে এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা বলে।”
অধ্যাপক এইচ. প্যানার (প্রফেসর এইচ. ফিনার) এর অর্থ, “একক সরকার এমন একটি যেখানে সমস্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা একটি কেন্দ্রে থাকে যার ইচ্ছা এবং সমগ্র এলাকা জুড়ে থাকে।”
অধ্যাপক আর. জি গেটেল (Prof. R. G. Gettell) বলেছেন, “যে শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সংবিধান একটি জাতীয় বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করে তাকে এককেন্দ্রিক সরকার বলে। “
পরিশেষে বলা যায়, যে সরকার ব্যবস্থায় শাসন বিষয়ক ও আইন বিষয়ক সকল ক্ষমতা নিয়মতান্ত্রিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অর্পিত থাকে, তাকে এককেন্দ্রিক সরকার বলে।
এককেন্দ্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ : এককেন্দ্রিক সরকারের কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো:
১. কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্য এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার দেশের সমগ্র শাসনকার্যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। কেন্দ্রীয় সরকারই কেবল সরকার পরিচালনায় সকল প্রকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এতে প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকারের কোন ভূমিকা নেই ।
২. সুপরিবর্তনীয় সংবিধান : এককেন্দ্রিক সরকারের সংবিধান সাধারণত সুপরিবর্তনীয় হয়। এতে সংবিধানের ধারাসমূহ পরিবর্তন করতে কোন জটিল পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয় না।
৩. দুর্বল বিচার বিভাগ : এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধান্য অনুপস্থিত। কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। যার ফলশ্রুতিতে বিচার বিভাগ দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪. কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্য : অধ্যাপক ডাইসি বলেন, “এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্য।” কেন্দ্রীয় আইনসভা যে কোন আইন প্রণয়ন বা রদ করতে পারে। এখানে সংবিধানের পরিবর্তে আইনসভার প্রধান্যকে মেনে নেয়া হয়। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন সকল সংস্থা বা আঞ্চলিক সরকারসমূহ পালন করতে বাধ্য থাকে।
৫. লিখিত অথবা অলিখিত সংবিধান: এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থার সংবিধান লিখিত হতে পারে আবার অলিখিতও। হতে পারে। যেমন- ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত, আবার ফ্রান্সের সংবিধান লিখিত।
৬. আঞ্চলিক সরকার গঠন: এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় প্রশাসনিক কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কতকগুলো আঞ্চলিক সরকার গঠন করতে পারে। আর আঞ্চলিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। আঞ্চলিক সরকারের কোন স্বাধীন অস্তিত্ব বা স্বাতন্ত্র্য নেই।”
৭. একক আনুগত্য : এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে নাগরিকগণ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি একক আনুগত্য প্রদর্শন করে। কেননা এরকম শাসনব্যবস্থায় দ্বৈত নাগরিকতার কোন স্থান নেই।
৮. সহজেই দখলযোগ্য : এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় আদালত কর্তৃপক্ষের কোন হস্তক্ষেপ না থাকায় কেন্দ্র ও বাইরে
থেকে যে কেউ অতি সহজেই ক্ষমতা দখল করতে পারে।
৯. নমনীয়তা : এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা নমনীয় প্রকৃতির হয়ে থাকে। যে কোন জরুরি অবস্থা বা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে এ সরকার যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
১০. অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়বহুল: এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় সমগ্র দেশব্যাপী একটিমাত্র সরকার বিদ্যমান থাকে।সুতরাং এ সরকার ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল হয়।
১১. ঐক্যের প্রতীক : এ সরকার ব্যবস্থা জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। এ ধরনের সরকার ব্যবস্থায় সমগ্র জনসমষ্টি একটিমাত্র কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি নিরঙ্কুশভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে। তাই তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবোধ সুদৃঢ় হয় ।
১২. ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য : ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্য এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা বিশেষ উপযোগী। রাষ্ট্র ক্ষুদ্র হলে কেন্দ্র থেকেই সমগ্র দেশে কর্তৃত্ব করা সম্ভব হয়। আয়তনে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের
মধ্যে ক্ষমতা কটনের প্রয়োজন পড়ে না। সুতরাং বলা যায়, এককেন্দ্রিক সরকার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্যই বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
১৩. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রদেশ বা অঞ্চলগুলোতে স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃত নয় ।
কারণ কেন্দ্রীয় সরকার এদের কাজে হস্তক্ষেপ করে থাকে।
১৪. কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা : এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় সকল ক্ষমতা কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত হয়। আঞ্চলিক সরকারকে
তাদের ক্ষমতা পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল হতে হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর মাঝেই এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রকৃত পরিচয় – নিহিত রয়েছে। কেন্দ্রের প্রাধান্য অতিমাত্রায় হওয়ায় এ সরকার ব্যবস্থা অন্যান্য সরকার ব্যবস্থা থেকে আলাদা। এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে বর্তমানে এ সরকারের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে।