এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর ।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন


অথবা, এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের তুলনামূলক আলোচনা কর।
অথবা, এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈসাদৃশ্য উল্লেখ কর ।

উত্তরঃ ভূমিকা : কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন এবং উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারকে প্রধানত এককেন্দ্রিক সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার এ দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধান অনুযায়ী সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ন্যস্ত থাকে। এ সরকার ব্যবস্থায় আঞ্চলিক সরকারের অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল। আর যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দেয়া হয়। এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা পরস্পর বিপরীতধর্মী সরকার ব্যবস্থা। তবে বর্তমান
বিশ্বে উভয় প্রকারের সরকারই প্রচলিত রয়েছে।

এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের মধ্যে পার্থক্য : এককেন্দ্রিক সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রকৃতিগত এবং গুণগত বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে তা উপস্থাপন করা হলো :

১. সংজ্ঞাগত পার্থক্য : যে শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় বা জাতীয় সরকারের হাতে
অর্পিত থাকে এবং কেন্দ্রীয় সরকারই প্রয়োজনমতো আঞ্চলিক সরকার গঠন করে কেন্দ্রীয়ভাবে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে তাকে এককেন্দ্রিক সরকার বলা হয়। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বলতে এমন একটি সরকার ব্যবস্থাকে বুঝায়, যেখানে সংবিধানের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে এমনভাবে ক্ষমতা বণ্টন করা হয় যে,উভয় সরকারই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারে।

২. ক্ষমতা বন্টন: যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্র ও প্রদেশসমূহের মধ্যে শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ক্ষমতা বণ্টিত হয়। কেউ কারও
বরাদ্দকৃত ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকারে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নাও থাকে।

৩. বিচার বিভাগের প্রধান্য যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনে বিচার বিভাগের প্রাধান্য স্বীকৃত। কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা ও
কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোন বিবাদ দেখা দিলে সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে তার রায় ঘোষণা করে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকারে বিচার বিভাগীয় প্রাধান্যের পরিবর্তে আইনসভার
প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্রিটেনে সুপ্রিম কোর্টের কোন প্রাধান্য নেই।

৪. লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয়: যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থায় সংবিধান লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় হয়। তাই সংবিধান পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধান লিখিত বা অলিখিত, সুপরিবর্তনীয় বা দুষ্পরিবর্তনীয় হতে পারে। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত ও সুপরিবর্তনীয়। সংবিধান সুপরিবর্তনীয় হলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামজস্য রেখে সহজেই পরিবর্তন করা যায়।

৫. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা : যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা, অত্যাবশ্যক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বিদ্যমান রয়েছে। প্রথম কক্ষ জনসাধারণের ভিত্তিতে গঠিত হয় এবং দ্বিতীয় রুক্ষ অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকারের জন্য বিরক্ত আইনসভা অপরিহার্য নয়।

৬. সংবিধানের প্রাধান্য: যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারে সংবিধানই সকল ক্ষমতার উৎস। অর্থাৎ এ সরকার ব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধানা পরিলক্ষিত হয়। কেন্দ্রীয় ও অঙ্গরাজ্যের সরকার সংবিধানের নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকারে সংবিধানের প্রাধান্য থাকে না। এখানে আইনসভার প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত হয়।

৭. ব্যয় সংক্রান্ত : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ এখানে দু’ধরনের সরকারের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা
যায়। কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় একটিমাত্র সরকার থাকে বলে এ সরকার ব্যবস্থা তুলনামূলকভাকে কম ব্যয়বহুল।

৮. স্বৈরাচারী প্রকৃতি: যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের প্রধান্য থাকে বলে কোন সরকারই স্বৈরাচারী হতে পারে না। কেননা সংবিধান কর্তৃক উভয় সরকারের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকারে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কুক্ষিগত থাকে। তাই এ সরকার স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

৯. বিনাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্রে বিনাগরিকত্ব পরিলক্ষিত হয়। একজন ব্যক্তি একদিকে কেন্দ্রীয় এবং অপরদিকে নিম্ন
প্রাদেশিক সরকারের নাগরিক। কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকারে নাগরিকত্ব এক এবং অবিভাজ্য।

১০. স্বায়ত্বশাসন : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারে অঙ্গরাজ্যের সরকারসমূহের অস্তিত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার থাকে। কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকারে রাষ্ট্র পরিচালনার একচ্ছত্র অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে। এখানে আঞ্চলিক সরকারের স্বতন্ত্র বা স্বাধীন সত্তা নেই।

১১. সরকারের প্রকারভেদ : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় দু’ধরনের সরকার বিদ্যমান থাকে। একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং কতকগুলো রাজ্য সরকার। উভয় সরকারই নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীনভাবে কার্যসম্পাদন করে থাকে। কিন্তু এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যমান থাকে।

১২. সৃষ্টিগত পার্থক্য : যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার এবং আঞ্চলিক সরকার উভয়েরই সৃষ্টি হয়। কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকারে কেন্দ্রীয় সরকারই অঞ্চলগুলো সৃষ্টি করে।

১৩.ঐক্য ও সংহতি: রাষ্ট্রের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় এককেন্দ্রিক সরকার বিশেষভাবে উপযোগী। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় এটি অনিশ্চিত।

১৪. আইন প্রণয়ন : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া অপেক্ষাকৃতভাবে বেশ জটিল। এখানে আইন প্রণয়নের সময় প্রতিনিধি সভা তথা জনমতের দরকার হয়। কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকারে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া তত কঠিন নয়। কারণ এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধানের ইচ্ছাই আইনে পরিণত হয়।

১৫. বিরোধ মীমাংসা : যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে সাংবিধানিকভাবে সে দ্বন্দ্বের নিরসন করা হয়। কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকারে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিরোধ দেখা দিলে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্বই বলবৎ থাকে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, এককেন্দ্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের মধ্যে গঠনগত এবং কার্যক্রমগত উপর্যুক্ত পার্থক্যগুলো পরিলক্ষিত হয়। তবে দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে এ উভয় প্রকার সরকার ব্যবস্থা হলো সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী দুটি
সয়কার ব্যবস্থা। তবে ক্রমশ এককেন্দ্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য হ্রাস পাচ্ছে।