উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিকীকরনের চ্যালেজ্ঞ

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্ব অর্জনের পথে যে চ্যালেঞ্জগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, সেগুলোকে মোটামুটি নিম্নলিখিত শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:

১. অর্থনৈতিক ও সামাজিক পশ্চাৎপদতা

  • দারিদ্র্য, বেকারত্ব, আয়ের বৈষম্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয়।
  • যখন মানুষের মৌলিক চাহিদা (খাদ্য, চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য) পূরণ হয় না, তখন তারা গণতন্ত্রের চেয়ে “শক্তিশালী নেতা” বা স্বৈরাচারী শাসনকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করে।
  • মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দুর্বলতা: গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য যে সচেতন, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত দরকার, উন্নয়নশীল দেশে তা প্রায়ই অনুপস্থিত বা দুর্বল।

২. প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা

  • নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, সেনাবাহিনী—এসব প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীন থাকতে পারে না।
  • দুর্নীতি এতটাই প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে যায় যে, গণতান্ত্রিক সংস্কারগুলো কাগজে-কলমে থেকে যায়।
  • “Rule of Law” এর পরিবর্তে “Rule by Law” প্রচলিত হয়।

৩. রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অভাব

  • অনেক উন্নয়নশীল দেশে ঔপনিবেশিক আমল বা সামরিক শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস থাকায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ (সহনশীলতা, আপস, বিরোধী দলের অধিকার) গভীরভাবে প্রোথিত হয়নি।
  • পৃষ্ঠপোষক-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক (patron-clientelism), জাতিগত-ধর্মীয় বিভাজন, পরিবারতন্ত্র, “বিজয়ী সব নেয়” মানসিকতা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে।

৪. জাতিগত, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক বিভাজন

  • বহুজাতিক, বহুধর্মী সমাজে গণতন্ত্র প্রায়ই “majority tyranny” বা সংখ্যাগুরুর স্বৈরাচারে পরিণত হয়।
  • উদাহরণ: শ্রীলঙ্কায় সিংহলি-তামিল বিভাজন, নাইজেরিয়ায় উত্তর-দক্ষিণ, পাকিস্তানে পাঞ্জাব-বেলুচ-সিন্ধু ইত্যাদি।

৫. সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব

  • সেনাবাহিনী প্রায়ই নিজেকে “রাষ্ট্রের রক্ষক” মনে করে এবং সুযোগ পেলেই ক্ষমতা দখল করে (পাকিস্তান, বাংলাদেশের অতীত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মিশর ইত্যাদি)।
  • বেসামরিক আমলাতন্ত্রও নির্বাচিত সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।

৬. বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও নির্ভরশীলতা

  • উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে দাতা দেশ ও সংস্থার ওপর নির্ভরশীল। ফলে গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের চেয়ে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পায়।
  • উদাহরণ: মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের মতো স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমারা সমর্থন দেয় তেল ও নিরাপত্তার কারণে।

৭. জনসংখ্যার চাপ ও শিক্ষার অভাব

  • বিশাল জনগোষ্ঠী, নিরক্ষরতা, গুজব ও মিথ্যা তথ্যের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া গণতন্ত্রকে পপুলিজম ও ধর্মীয় উগ্রতার হাতে তুলে দেয় (যেমন: ভারতে কিছু ক্ষেত্রে, ইন্দোনেশিয়ায় অতীতে)।

৮. গণতন্ত্রের “হাইব্রিড” রূপ

  • অনেক দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিবর্তে “নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র” (electoral authoritarianism) বা “প্রতিযোগিতামূলক স্বৈরতন্ত্র” গড়ে ওঠে—যেখানে নির্বাচন হয় কিন্তু ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে (রাশিয়া, তুরস্ক, ভেনেজুয়েলা, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা ইত্যাদি)।

সারসংক্ষেপ

উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—একই সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো। এই তিনটি একসঙ্গে না এলে গণতন্ত্র হয় অস্থির (ঘন ঘন অভ্যুত্থান) নতুবা কাগজে-কলমে থেকে যায়।

দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, চিলি, ঘানা, বতসোয়ানার মতো কিছু ব্যতিক্রম আছে—যারা ধীরে ধীরে এই তিনটি ক্ষেত্রেই সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষেত্রে পথটা এখনও দীর্ঘ ও কণ্টকাকীর্ণ।