উদারনীতিবাদ সম্পর্কে মেরি ওলস্টোন ক্রাফটের মতবাদ আলোচনা কর।

অথবা, মেরি ওলস্টোন ক্রাফটের নারী উদারণীতিবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, উদারনীতিবাদ সম্পর্কে মেরি ওলস্টোর্ন ব্রুকটের মতামত উল্লেখ কর।
অথবা, মেরি ওলস্টোন নাটকের উদারনীতিবাদ মতবাদটি স্বরূপে বর্ণনা কর।
অথবা, নারী উদারনীতিবাদ বিষয়ক মেরির ধারণাটি তুলে ধর।
অথবা, নারী উদারনীতিবাদ বিষয়ক মেরি ওলস্টোন ক্রাফটের মতবাদটি সম্পর্কে তুমি যা জান বিস্তারিত লিখ
উত্তর৷ ভূমিকা :
বিগত বিংশ শতাব্দীর সংস্কারপন্থি নারীবাদ পূর্বসূরীদের অনুসরণে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোতে আইনগত, সামাজিক ও অন্যান্য সংস্কার সাধন করে নারীর অবস্থান উন্নত করতে প্রয়াসী হন। এদের মধ্যে বেটী ফিডেন অন্যতম ছিলেন। বেটী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারী আন্দোলনের অগ্রদূত জাতীয় নারী সংগঠন (NOW) এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এ সংগঠনে উদারপন্থি সদস্যদের প্রাধান্য ছিল। এছাড়াও এ মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন মেরি ওলস্টোন ক্রাফট, টেইলর, জনস্টুয়ার্ট মিল প্রভৃতি উদারতাবাদী রাজনীতিবিদ। তাঁদেরকে অনুসরণ করে পরবর্তীতে তাত্ত্বিকরা তত্ত্ব দিয়েছেন। মেরির একশত বছর পরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মিল ও টেইলর নারীর পক্ষে দাঁড়ালেন। মিল ও টেইলরের মধ্যে ঐকমত্য থাকলেও কতিপয় বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল। মেরি নারীর জন্য শিক্ষাকে মুক্তির একমাত্র উপায় চিহ্নিত করেছেন। মিল এবং টেইলর অভিন্ন শিক্ষার পাশাপাশি নারী পুরুষের অভিন্ন রাজনৈতিক অধিকার ও সমান অর্থনৈতিক সুবিধার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন।
মেরি ওলস্টোন ক্রাফটের মতবাদ : উদারনীতিবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যেসব নারীবাদী মহিলা নারীমুক্তির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে মেরি ওলস্টোন ক্রাফট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর নারীবাদী তত্ত্বগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. শিল্পবিপ্লব : মেরির মতবাদের মূল বক্তব্য হলো অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প পুঁজিবাদ শিল্পবিপ্লবের আগে যুক্তরাজ্যে সকল উৎপাদন কর্মকাণ্ড গৃহে বা গৃহের আশপাশে সংঘটিত হতো। নারী পুরুষ উভয়ই অংশ নিত। শিল্পবিপ্লব সবকিছুকে উলটপালট করে ফেলে । শিল্প পুঁজিবাদ উৎপাদন কর্মকাণ্ডকে গৃহ থেকে কারখানায় স্থানান্তরিত করে। উৎপাদন কর্মকাণ্ড গৃহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পুরুষ ঘরের বাইরে গিয়ে শিল্পকারখানায় কাজ নেয়। এতে পুরুষ সভ্যতার অবদানে সামিল হয়

কিন্তু নারী থেকে যায় ঘরে। গৃহে নারীর উৎপাদন কর্ম না থাকায় নারী কর্মহীন গৃহবধূ হয়ে পড়ে।
২. নারীর অবস্থা : মেরি গৃহবন্দি স্ত্রীদেরকে খাঁচায় বন্দি রঙিন পুচ্ছ পক্ষীকুলের সাথে তুলনা করেছেন। ফুলের মতো নারীদের ঘরে সাজিয়ে রাখা হয়। কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার এদের নেই, ফলে এরা পরাধীন। এদের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়, ফলে এদের মানবিক গুণাবলির অভাব রয়েছে। এদের একমাত্র কর্ম
আরাম আয়েশে থাকা এবং পুরুষের মনোরঞ্জন করা। নারী পরিণত হলো পুরুষের ভোগের সামগ্রীতে। নারী বিচারবুদ্ধি বিবর্জিত ভাবপ্রবণ চরিত্রের অধিকারী।
৩. নারী প্রকৃতির স্ববিরোধিতা : মেরি বলেছেন, “নারী এরূপ চরিত্রায়ন স্বভাবগত বা প্রকৃতিগত নয় এবং হতেও পারে না। কারণ বিচারবুদ্ধি মানবকুলকে পশুকুল থেকে পৃথক করেছে।” নারী ও পুরুষ উভয়ই মানুষ। কাজেই নারী ও পুরুষ উভয়েরই বিচারশক্তি থাকতে বাধ্য। পৃথক করে নারীকে বঞ্চিত করা মানে জাতিকে বঞ্চিত করা। নারী মানুষ, অথচ
বিচার শক্তিবিহীন, এমন বক্তব্য স্ববিরোধী ও যুক্তি বিবর্জিত। কাজেই নারীর মধ্যে বিচারবুদ্ধির অভাবের কারণ তার স্বভাব বা প্রকৃতি নয়, এ অবস্থা সমাজকর্তৃক সৃষ্ট, যা কোনো সভ্য সমাজের জন্য কাম্য নয়।
৪. নারী উন্নয়নে শিক্ষা : মেরি নারীর মধ্যে শিক্ষার অভাবকে নারীর দূরবস্থার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, যথার্থ শিক্ষার মাধ্যমে নারীমুক্তি সম্ভব। মানবিক সম্ভাবনার পরিপূর্ণ স্ফুরণ এবং বিচারবুদ্ধি ও নৈতিক শক্তির বিকাশের সহায়ক শিক্ষা প্রদান করা। নারীকে সচেতন করতে শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নারীর চারিত্রিক অসম্পূর্ণতা দূর হবে। নারী বিচারবুদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ হবে। মেরির মতে, “শিক্ষিত নারীর গৃহস্থালির কাজ ও সন্তান পালনের দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পাদনে সক্ষম হবে। এভাবে নারীরা সমাজের কল্যাণে অবদান রাখবে।”
৫. অভিন্ন শিক্ষা : উদারতাবাদে বিশ্বাসী মেরি নারী পুরুষের অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার উপর জোর দিয়েছেন। বালক- বালিকাকে অভিন্ন শিক্ষা দিতে হবে। তবেই জেন্ডার বৈষম্য সমাজ হতে দূর হবে। কারণ বিচারবুদ্ধি ও নৈতিক শক্তি বিকাশের জন্য নারী পুরুষের সমান সুযোগ সুবিধা থাকা আবশ্যক। সকল মানব সন্তানের সমান সুযোগ অপরিহার্য, যাতে তারা
পরিপূর্ণ ব্যক্তিসত্তা অর্জন করতে পারে। মেরি নারীর ব্যক্তিসত্তা বিকাশের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছেন।
৬. নারী বস্তুতে পরিণত : মেরির বিশ্বাস যে, স্ত্রী নিজেকে গুল্ম হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেয়। এ অবস্থা মানব হিসেবে তার ব্যক্তিসত্তা লোপ পায়। নিজের বিকাশ ও নিজেকে মহীরূহে পরিণত করার সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পরিবর্তে সে তার স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়ে একটি প্রতিকী ক্ষণজীবী লজ্জাবতী লতায় পর্যবসিত হয়। মেরি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন যে, কোনো
নারী কখনো নিজেকে এমন নির্যাতিত হতে দিতে পারে না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, উদারপন্থি সকল নারীবাদী প্রবক্তা একমত যে, ব্যক্তির জৈবিক সেক্স তার মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক জেন্ডার নিরূপণ করে না। যেসব শিক্ষা ও আইন সংস্কারের সুফল আজ নারীরা ভোগ করছে তার পিছনে এদের অবদান অনস্বীকার্য। উদারপন্থী নারীবাদী আন্দোলনের প্রচেষ্টা না থাকলে নারী আজকে যে পেশাগত ও বৃত্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে তা সম্ভব হতো কি না সন্দেহ।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80-%e0%a6%93-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%90%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%93/