অথবা, বৌদ্ধ দর্শনে ঈশ্বরের স্থান নিরূপণ কর।
অথবা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে প্রদত্ত বৌদ্ধ দার্শনিকদের যুক্তিগুলো তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : গৌতম বুদ্ধের বাণী ও উপদেশের উপর নির্ভর করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সে মতবাদই বৌদ্ধদর্শন। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও বুদ্ধ বাল্যকাল হতে চিন্তাশীল এবং বৈরাগ্যভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি নিজের আত্মশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষতলে বহু বছর কঠোর তপস্যা করে জগতে দুঃখের রহস্য ও স্বরূপ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। গৌতম বুদ্ধ এবং তার শিষ্যগণ কর্তৃক ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে প্রদত্ত যুক্তিগুলো নিম্নরূপ :
পরিণতি কারণের অস্তিত্ব অস্বীকার : বৌদ্ধগণ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। তাই বৌদ্ধ দর্শনে ঈশ্বরের স্থান নেই। বৌদ্ধগণ বলেন, প্রত্যেক কার্যের কারণ আছে। কিন্তু পরিণতি কারণ বলে কিছু নেই। সুতরাং পরিণতি কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেবার কোন প্রয়োজন নেই বলে তারা মনে করেন।
নৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে : নৈতিক অগ্রগতির জন্য ঈশ্বরের সাহায্যের কোন প্রয়োজন নেই বলে বৌদ্ধরা মনে করেন। তাদের মতে, ঈশ্বরের বিশ্বাস নৈতিকতার ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি করে। ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, সবকিছুর কারণ হন এবং তার ইচ্ছায় যদি জগতের সবকিছু ঘটে থাকে তবে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা কোথায় মানুষ ধর্ম বা সৎ আচরণের ও ভালো চরিত্র গঠনের প্রয়োজন অনুভব করবে কেন?
কর্ম নিয়মের ব্যাখ্যা : গৌতম বুদ্ধ কর্ম নিয়মকে সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন। কর্ম নিয়মের সাহায্যে জগতে জীবের দুঃখ-দুর্দশার ব্যাখ্যা করা যায়। কর্মের ফলে জীবের জন্ম ও বিকাশ হয়। সুতরাং সৃষ্টিকর্তারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের কোন প্রয়োজন পড়ে না।
আদি কারণ বিষয়ক যুক্তির সমালোচনা : গৌতম বুদ্ধের মতে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য সাধারণত আদি কারণ বিষয়ক যে যুক্তি দেয়া হয় তা গ্রহণযোগ্য নয়। এই যুক্তি অনুসারে জগতের একটি স্বয়ংসৃষ্ট আদি কারণ আছে। কিন্তু এই আদি কারণ বা ঈশ্বরে বুদ্ধ বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে, জগতের কারণ জগৎই স্বয়ং। তাছাড়া স্বয়ংসৃষ্ট কারণের ধারণা আত্মবিরোধপূর্ণ ।
উদ্দেশ্যবিষয়ক যুক্তির সমালোচনা : ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক প্রচলিত উদ্দেশ্য বিষয়ক যুক্তিটিকে বুদ্ধ মেনে নেন নি। এই যুক্তি অনুসারে ঈশ্বর জগতের সৃষ্টিকর্তা। আমরা জানি, ঈশ্বর পূর্ণ, জগৎ অপূর্ণ, কিন্তু বুদ্ধ বলেন, ঈশ্বর যদি পূর্ণ হন, তবে তিনি কেমন করে অপূর্ণ জগৎ সৃষ্টি করেন। খেয়ালবশতও ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন না। কারণ এই জগতে নিয়মশৃঙ্খলা বিদ্যমান। কিন্তু খেয়ালবশত যে কাজ করা হয় তাতে কোন নিয়মশৃঙ্খলা থাকে না। তাই ঈশ্বর অস্তিত্বহীন।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, গৌতম বুদ্ধ এবং তার শিষ্যরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য পূর্ববর্তী দার্শনিকরা যেসব যুক্তি প্রদান করেছিলেন বৌদ্ধরা সেগুলোর সমালোচনার মধ্য দিয়েই মূলত ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। সে যাই হোক, তাদের মতবাদের বিরুদ্ধে পরবর্তীকালে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হলেও তাদের মতবাদের দার্শনিক গুরুত্ব যে অপরিসীম তা নির্দ্বিধায় বলা যায়