অথবা, স্বাধীন চিন্তা বলতে কি বুঝ? ইসলামে স্বাধীন চিন্তার সম্ভাব্যতাকে মূল্যায়ন কর।
অথবা, ইসলামে স্বাধীন চিন্তার সম্ভাব্যতা আলোচনা কর।
অথবা, ইসলামে স্বাধীন চিন্তার সম্ভাব্যতা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর ভূমিকা : জ্ঞানানুশীলন ও সত্যানুসন্ধানের বিষয় হিসেবে দর্শনের ক্ষেত্র এত ব্যাপক যে, এর কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন সম্ভব নয়। তবে দর্শন সম্পর্কে আমরা বলতে পারি যে, জগৎ ও জীবনের মৌলিক সমস্যা সম্পর্কে আমাদের যৌক্তিক ও বিশ্লেষণী যে দৃষ্টিভঙ্গি তাই দর্শন। মৌলিক সমস্যা বলতে বোঝায় এমন সমস্যা, যা সব মানুষের কাছে একটি জানার বিষয়। যেমন- মূল্য কি? সত্য কি? ভালো কি? মন্দ কি?। তাই আমরা দেখি যে, এসব সমস্যা নিয়ে পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা যেমন ভাবিত হয়েছেন তেমনি ভাবিত হয়েছেন মুসলিম দার্শনিকরা। ঐতিহ্যগতভাবে তারা কুরআন ও হাদিসের আলোকে তাদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে সুচিন্তিত মত দিয়েছেন। আর এভাবেই গড়ে উঠেছে মুসলিম দর্শন।
ইসলামে স্বাধীন চিন্তার সম্ভাব্যতা : মানুষের ইতিহাসে যখন স্বাধীন চিন্তার ঐতিহ্য খুব একটা প্রচলন হয়। নি, বরং যখন স্বাধীন চিন্তা একটি অমার্জনীয় অপরাধ বলেই গণ্য হতো সে যুগে মুসলিম দার্শনিকরা স্বাধীন চিন্তার পথে অগ্রসর হতে চেষ্টা করেছেন। ড. গোবিন্দ্র চন্দ্র তাঁর ‘মুসলিম দার্শনিকদের স্বকীয়তা’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন, প্লেটো এরিস্টটলের কাজ থেকেই হোক আর হাদিস থেকেই হোক, আর এ দু’ই থেকে হোক প্রেরণা নিয়ে তারা যে স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের আগের কিংবা কিছু পরের ইতিহাসেও তার খুব নজির নেই।”
মুসলিম দার্শনিকদের অনেকেই চিরাচরিত রীতিনীতি অন্ধভাবে মেনে নেন নি তারা স্পিনোজার মত সংসারবিরাগী ছিলেন না, বরং তাদের কারও কারও উল্টো দিকেই প্রবণতা ছিল। তবে স্বাধীন চিন্তা ও স্বকীয়তা জন্য তারা যে অনেক লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহ্য করেছেন তাতে সন্দেহ নেই। আর এর রয়েছে ঐতিহাসিক সত্যতা। মুসলমান চিন্তাবিদদের
বুদ্ধিবাদের আতুরঘর মুতাজিলাদের উপর প্রচুর অত্যাচার হয়েছে। ইবনে রুশদের স্বাধীন চিন্তায় জর্জরিত হয়ে তার কর্মস্থল কর্ডোভার শাসক মনসুর জনমতের চাপে ফরমান জারি করেছিলেন। “যারা আল্লাহর ওহী ছাড়া শুধু বিচারের দ্বারা তত্ত্ব নির্ণয় হয় বলে মনে করে তাদের অনন্তকাল দোজখের আগুনে পুড়ে মরতে হবে, এটাই আল্লাহর বিধান।” ইসলামে যদি স্বাধীন চিন্তা সম্ভব না হয়, তাহলে মুসলিম চিন্তাবিদগণ কেন এত অত্যাচার সহ্য করেছিলেন। আধুনিক ইউরোপীয় মনীষীদের অনেকের মতে, দার্শনিক স্বাধীন চিন্তার এক বড় উদাহরণ প্রাচীন ইতিহাসে গ্রিকদর্শনকেই স্বাধীন চিন্তার এক বড় উদাহরণ বলতেও সংকোচবোধ করেন নি। তবে কেন প্রাচীন গ্রিক দর্শনকে স্বাধীন চিন্তার মডেল বলা হচ্ছে। গ্রিক দর্শনে যে স্বকীয়তা ও মৌলিকতা, তার মূলেও ছিল এক বিপ্লবী মনোবৃত্তি। হোমার ও
হেসিত্তর জনপ্রিয় কাব্যের মারফত গ্রিক দর্শনের জন্মের বহু আগে জনমনে যে ঐতিহ্যের ইমারত গড়ে উঠেছিল, তার বিরুদ্ধে অভিমান গ্রিক দার্শনিক চিন্তার এক বড় উপাদান ও উপজীব্য। দেবদেবীতে মানুষের দুর্বলতার আরোপ হোমার ও হেসিত্তডে সুস্পষ্ট। আর এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হল গ্রিক দর্শন যা মেলিস হতে শুরু হয়ে প্লেটো পর্যন্ত নানাভাবে নির্দেশিত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে এ্যানাক্সোগোরাস সূর্য ও চন্দ্র দেবতা নন, নিষ্প্রাণ জড় পদার্থ- একথা বলায় তার প্রানহানির ব্যবস্থা হয়। পরে এথেন্সের জননায়ক বন্ধ পেরিক্লিসের সাহায্যে পালিয়ে আত্মরক্ষা না করলে তাকে হয়ত এ গুরুতর অপরাধের দায়ে মরতেই হতো। মুসলিম দার্শনিকরা প্লেটো এরিস্টলের অযৌক্তিক ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন বলে মনে হয় না। কেননা, তারা বিনা বিচারে তাদের মতবাদকে গলধকরণ করেছেন এমন অভিযোগ তাদের বি
রুদ্ধে করা চলে না। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মতে, এটাও তাদের স্বাধীন চিন্তার অনুকূলে বড় যুক্তি।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানুষ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে তা হতে শিক্ষা লাভ করে থাকে। শুধু তাই নয়, একটি জাতির সামগ্রিক বিকাশের জন্য অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এ উভয় দিকের বিকাশের প্রয়োজন। মহামতি এরিস্টটলের মতে, কি দার্শনিক, কি সংস্কৃতি চর্চাকারী সকলেরই দু’টি জিনিস প্রয়োজন : ১. সম্পদ ২. অবসর। তাই অর্থনীতি ও সুনীতি উভয়ের যুগপৎ চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমেই সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি সম্ভবপর হয়ে উঠবে। মুসলিম চিন্তাবিদগণ এজন্য সভ্যতার বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে এমনভাবে তাকে রূপান্তরিত করেছেন, যা সেসব বিষয়কে ছাড়িয়ে তাদের নিজস্বতার স্বাক্ষর বহন করে ইতিহাসে তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছে।