Download Our App

ইলিয়াস শাহ সম্পর্কে যা জান লিখ।

উত্তর : ভূমিকা : বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসে যে সকল ভাগ্যবান ব্যক্তি নিজ বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব ও সাহসের মাধ্যমে উন্নতির চরম শিখরে পৌছে ছিলেন তাদের মধ্যে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ
অন্যতম। তিনি ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠা করে বাংলায় মুসলিম প্রধান্য প্রতিষ্ঠায় নবযুগের সূচনা করেন।
১. ইলিয়াস শাহের পরিচয় : ইলিয়াস শাহের পূর্ব নাম ছিল হাজী ইলিয়াস। তিনি ইরানের সিজিস্তান থেকে ভারতবর্ষে আসেন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ফিরোজ শাহ তুঘলকের
একজন নগণ্য ভৃত্য। পরবর্তীতে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করে একজন দুঃসাহসিক সৈনিক ও দক্ষ সেনানায়কের পদে
উন্নীত হন। একদা তিনি তার সেনাদলকে বাধ্য করে প্রতিদ্বন্দ্বী আলী মুবারককে হত্যা করেন এবং ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ‘শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’ উপাধি ধারণ করে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
২. রাজ্যজয় : সুলতান ইলিয়াস শাহ বাংলার সিংহাসন লাভ করেই ক্ষান্ত হননি বরং তিনি রাজ্যবিস্তারেও মনোনিবেশ করেন।
তিনি প্রথমেই ত্রিহুত জয় করেন। এ সময় বঙ্গের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ত্রিহুত রাজ্যে গৃহযুদ্ধ চলছিল। শক্তিসিংহ ও কামেশ্বর
নামক দুজন শাসকের মধ্যে সমগ্র ত্রিহুত রাজ্য বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দে এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর আত্মকলহের সুযোগে
ইলিয়াস শাহ ত্রিহুত জয় করেন। অতঃপর ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নেপাল আক্রমণ করেন।
৩. দুঃসাহসী সৈনিক ও দক্ষ সেনানায়ক : ইলিয়াস শাহ ছিলেন একজন দুঃসাহসী সৈনিক ও দক্ষ সেনানায়ক। সৈন্যবাহিনীর উপর তার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এবং সৈন্যরাও তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। এমনকি তার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত ছিল। একের পর এক রাজ্য বিজয়ে সাফল্য তার দক্ষতা ও প্রতিভারই পরিচয়। ইলিয়াস শাহ একজন কুশলী সমরবিদও ছিলেন।
৪. স্বাধীন সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা : স্বাধীন সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইলিয়াস শাহ বাংলার ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি ছিলেন সমগ্র বাংলার একচ্ছত্র অধিপতি। বাংলায় মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠা সর্বপ্রথম তারই অবদান। সে যুগে ইলিয়াস শাহের সুদীর্ঘ পনের বছরের
রাজত্বকাল তার যোগ্যতারই পরিচয় বহন করে।
৫. অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো : ইলিয়াস শাহের সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা এবং অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোর ভিত্তিমূল মজবুত হওয়ার কারণে তিনি শাসক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তার শাসনামলে রাজ্যে সম্পূর্ণভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজিত ছিল। তিনি যেভাবে রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন তা স্বাধীন
সালতানাতের অবকাঠামো সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। ইলিয়াস শাহের শাসনব্যবস্থা মধ্যযুগীয় বাংলায় এক
উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের স্বাক্ষর বহন করে।
৬. গৌরবময় বিজয় : ইলিয়াস শাহ ছিলেন গৌরবময় বিজয়ের অধিকারী এক বীর্যবান পুরুষ। সিংহাসন লাভ করে তিনি বাংলার গৌরব বৃদ্ধির জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালান। তিনি একে একে ত্রিহুত, নেপাল, উড়িষ্যা, চম্পরাণ, গোরক্ষপুর, সোনারগাঁও ও কামরূপ অধিকার করেন। একের পর এক এ
অঞ্চলগুলোর বিজয়ের মধ্যে তার দূরদর্শিতা, দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।
৭. সুযোগ্য শাসক : সুলতান ইলিয়াস শাহ শুধু বিজেতাই ছিলেন না বরং একজন সুযোগ্য শাসক হিসেবেও তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তিনি কঠোরহস্তে দুষ্টের দমন করে শিষ্টের পালন করেছিলেন। তার শাসনামলে দেশের সর্বত্র সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজমান ছিল। প্রজাবৎসল সুলতান সর্বদা হিন্দু-
মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। সুখ শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তার শাসনকাল স্মরণীয় হয়ে আছে।
৮. স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা : স্থাপত্যশিল্পের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও সুলতান ইলিয়াস শাহ বিশেষ খ্যাতি অর্জন
করে ন। তৎকালীন স্থাপত্যশিল্পে তার অবদান ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হাজীপুর নামক একটি শহর নির্মাণ করেন। তিনি শায়খ আলাউল হকের সম্মানে একখানি মসজিদ তৈরি করেন।
৯. ধর্মনিষ্ঠা : ইলিয়াস শাহ একজন ধর্মনিষ্ঠ শাসক ছিলেন। তিনি সুফি-দরবেশ ও দ্বীন প্রচারক মুসলিদের খুব সম্মান করতেন।
তার সময়ে বাংলায় তিনজন সুফির নাম পাওয়া যায়। যথা- শায়খ আলী সিরাজউদ্দিন, তার শিষ্য আলাউল হক এবং শায়খ রাজা
বিয়াবাণী। তার পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিগগণ বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পান।
উপসংহার : উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্বাধীন সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা
করেন। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলার ইতিহাসে এমন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেন যা বাংলায় প্রায় দুশ বছর টিকে ছিল ।