ইয়াহিয়া খান কিভাবে ক্ষমতায় আসে তার প্রেক্ষাপট বর্ণনা কর।

অথবা, কিভাবে আইয়ুব শাসনের অবসান হয়?
উত্তর৷৷ ভূমিকা :
আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জার হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। আইয়ুব সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের উপর বিভিন্ন সময় দমনপীড়ন চালায়। আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করে। এ মিথ্যা মামলা প্রতিহত করতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি যা আইয়ুব সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছিল ।
আইয়ুব শাসনের পতনের কারণ : আইয়ুব শাসনামল ছিল বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থা। এ সময় আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবুর রহমান ও পূর্ব বাংলায় নিষ্পেষণ ও শোষণ করে, ফলে তার পতন হয়। এছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ কারণে আইয়ুব শাসনের পতন হয়। নিচে তা আলোচনা করা হলো :
১. রাজনৈতিক অধিকার খর্ব : আইয়ুব খান এক আদেশবলে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেয়। এতে জনগণ আইয়ুব সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে। জনগণ তাদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পেতে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের বিরোধিতা করে।
২. ছয় দফার ভূমিকা : আইয়ুব পতনের অন্যতম কারণ ছিল ছয় দফা দাবি। ছয় দফার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রাজনৈতিক সচেতন হয় ও তাদের শোষণ বুঝতে পারে। এতে তারা ছয় দফা দাবি আদায়ে আইয়ুব সরকারের পতনের পথ এগিয়ে দেয়। ফলে আইয়ুবের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
৩. ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন : আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের শরীফ শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কালা-কানুন চালু করে। শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ সকল শ্রেণির ছাত্ররা এ শিক্ষা কমিশনের বিরোধিতা করে।
৪. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব : আইয়ুব খান তার শাসনামলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে। এতে জনগণ হতাশ হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জনগণ বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ জানায়, যা আইয়ুব পতনের পথ অনেকটা প্রশস্ত করে।
৫. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : আইয়ুব খান শরীফ শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে ইংরেজিকে প্রাধান্য দিয়ে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা ও বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাছাড়া আইয়ুব সরকার ‘নববর্ষ পালন নিষিদ্ধ, রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করে, ভারতীয় বই ও চলচ্চিত্র আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এতে করে দিনে দিনে জনগণের মনে আইয়ুব বিরোধী ক্ষোভ সৃষ্টি হতে থাকে ।
৬. National Democratic Front গঠন : আইয়ুব সরকার যখন সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তখন আইয়ুববিরোধী সদস্যরা পূর্ব পাকিস্তানে এডভোকেট আফসার উদ্দীনকে আহ্বায়ক করে National Democratic Front (NDF) গঠন করে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ব্যবস্থা আরো জোরদার করে তোলে।
৭. ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান : আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে দমন করার লক্ষ্যে ‘আগরতলা’ মামলা দায়ের করে। এতে জনগণ তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এক সময় ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। ফলে আইয়ুব সরকার মামলা প্রত্যাহার ও ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকারের পতন হয়। কিন্তু ক্ষমতায় আসে আরেক হত্যাকারী জে. ইয়াহিয়া খান। তিনি নির্বাচনের কথা বলে, নির্বাচনে পরাজিত হয়েও ক্ষমতা হস্তান্তরে পাঁয়তারা শুরু করেন। ফলে সত্যিকারের স্বৈরশাসকের পতন ত্বরান্বিত হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ।