ইবনে সিনার দর্শন সংক্ষেপে তুলে ধর।

অথবা, ইবনে সিনার দর্শন তত্ত্ব সংক্ষেপে লিখ।
অথবা, ইবনে সিনার দর্শন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও।
অথবা, ইবনে সিনার দর্শন সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ইবনে সিনার দর্শন তত্ত্ব সম্পর্কে যা জান সংক্ষেপে লেখ।
উত্তরা৷ ভূমিকা :
মুসলিম দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে কয়েকজন বিখ্যাত চিন্তাবিদের নাম আমাদের মানস পটে ভেসে উঠে ইবনে সিনা তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি জ্ঞানের গভীরতা, প্রজ্ঞা, চিন্তাশক্তি ও বিশ্বজনীন উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সকল সমাজে সমাদৃত। জ্ঞানের অন্যান্য শাখার পাশাপাশি তিনি দর্শনেও অসামান্য অবদান রেখেছেন।
ইবনে সিনার দর্শন তত্ত্ব : তিনি আল কিন্দি ও আল ফারাবির দর্শনতত্ত্বকে আত্মস্থ করে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি দর্শনে ও ধর্মকে সম্পূর্ণ পৃথক বলে মনে করেন। তিনি যে দার্শনিক মতবাদ দিয়েছেন তা নিম্নরূপ :
১. যুক্তিবিদ্যা : ইবনে সিনা যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিক আল-ফারাবি কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তিনিও আল-ফারাবির সাথে একমত পোষণ করে বলেন যে, সত্যানুসন্ধান যুক্তিবিদ্যার বিকল্প নেই। দার্শনিক হিসেবেও তিনি সত্যানুসন্ধানী। তাঁর যাবতীয়দার্শনিক আলোচনার সূচনা যুক্তির মধ্য দিয়েই হয়েছে। তিনি “আল নাযাত” রচনায় যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এছাড়া “আল ইশরাত” নামক গ্রন্থেও তিনি যুক্তিবিদ্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরিস্টটলের মতো তিনিও বচনের দুটি অংশ উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের কথা স্বীকার করেন। সুষ্ঠু চিন্তার ভিত্তি হিসেবে সংজ্ঞায়নের উপরও জোর দেন। তিনি যুক্তিবিদ্যাকে গণিত ও বিজ্ঞানের চেয়ে উন্নততর বলেছেন।
২. মনোবিদ্যা : তিনি একজন বিখ্যাত চিকিৎসক। তিনি মনে করেন দৈহিক বর্ণনার দ্বারা মানুষের সার্বিক বর্ণনা প্রদান সম্ভব নয়। দেহের পাশাপাশি মানুষের আরেকটি বৃত্তি রয়েছে, যা আত্মা নামে পরিচিত। আত্মা দেহ হতে পৃথক সত্তা। এ আত্মা বিশ্ব আত্মা হতে এসেছে এবং আকস্মিকভাবে দেহে যুক্ত হয়েছে। তিনি আত্মাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা : উদ্ভিদ আত্মা, জীবাত্মা ও মানবাত্মা। মানবাত্মার দুটি দিক রয়েছে। যথা : বিশুদ্ধ বুদ্ধি এবং ব্যবহারিক বুদ্ধি। দেহ ও আত্মা সম্পর্কিত তাঁর এ ব্যাখ্যা আধুনিক যুগেও প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে।
৩. অধিবিদ্যা : অধিবিদ্যা ইবনে সিনার চিন্তার স্বাতন্ত্র্যে পরিলক্ষিত হয়। তিনি আধ্যাত্মিক শক্তিকে পার্থিব শক্তির ঊর্ধ্বে উন্নীত করেছিলেন। তিনি আত্মাকে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব স্তরের মধ্যবর্তী শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি আল্লাহকে শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক সত্তা বলেছেন যা নিশ্চয়াত্মক এক যার উপর সকল সত্তা নির্ভরশীল। তবে তিনি কারো উপর নির্ভরশীল নন। তিনি সত্তাকে এভাবে নিশ্চয়াত্মক ও সম্ভাব্য দুভাগে ভাগ করেন। তিনি অস্তিত্বকেও সম্ভাব্য অস্তিত্ব ও অনিবার্য অস্তিত্বে ভাগ করেন। এ অনিবার্য সত্তাই আল্লাহ। তার থেকেই কর্তৃত্বের উদ্ভব।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইবনে সিনা বিজ্ঞান ও দর্শনতত্ত্বের সমন্বয় করে তাঁর দার্শনিক তত্ত্বসমূহ উপস্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী মুসলিম দার্শনিক এবং গ্রিক দর্শন দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি দর্শনকে গ্রহণযোগ্য স্থানে নিয়ে যান। তিনি কালজয়ী চিন্তাধারার প্রবর্তক এবং মুসলিম দার্শনিকদের অন্যতম নির্দেশনা দানকারী।