ইবনে রুশদ কিভাবে আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে দার্শনিকদের যুক্তি ও ইমাম আল গাজালির যক্তির সমন্বয় সাধন করেছেন?

অথবা, আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে ইবনে রুশদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা কর।
অথবা, ইবনে রুশদ কিভাবে আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে দার্শনিকদের যুক্তি ও ইমাম আল গাজালির যুক্তির সমন্বয় সাধন করেন ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে ইবনে রুশদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মুসলিম পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন ইবনে রুশদ। তার পুরো নাম আবুল ওয়ালিদ মোহাম্মদ ইবনে আহাম্মদ ইবনে রুশদ। দার্শনিক ইবনে বাজা ও ইবনে তুফায়েল ছিলেন তার দার্শনিক শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম। ইবনে রুশদ যেসব দার্শনিক মতবাদ দিয়েছেন তাদের মধ্যে আল্লাহর গুর্ণাবলি সম্পর্কে ব্যাখ্যা অন্যতম। তিনি আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে দার্শনিকদের মতবাদ ও গাজালির মতবাদকে সমন্বিত করার
চেষ্টা করেন।
আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে ধারণা : দার্শনিকদের মধ্যে আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে। মুসলিম দর্শনে প্রথম পর্যায়ের প্রায় সব ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায় এ বিষয়টি নিয়ে তাদের মতবাদ আলোচনা করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায় হলো মুতাজিলা ও আশারিয়া। আল্লাহর একত্ব রক্ষার অজুহাতে আল্লাহর উপর কোন
গুণআরোপ করতে মুতাজিলা সম্প্রদায় অস্বীকৃতি জানায়। আর আশারিয়া সম্প্রদায় আল্লাহর গুণাবলি স্বীকার করে নেন।
ফালাসিফা সম্প্রদায়ের সুমলিম দার্শনিকগণ গ্রিক দার্শনিকদের প্রভাবে মুতাজিলাদের মতো আল্লাহর গুণাবলি স্বীকার করেন না। দার্শনিকগণের এসব মতবাদ ইমাম আল গাজালি কর্তৃক সমালোচিত হয়। ইবনে রুশদ আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে দার্শনিক ও গাজালির মতবাদের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়াস নেন।
আল্লাহর গুণাবলি প্রসঙ্গে দার্শনিকদের যুক্তি : দার্শনিক সম্প্রদায় আল্লাহর কোন গুণ নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তাদের এ মতবাদ প্রমাণ করার জন্য তারা বলেন যে, যদি আল্লাহর গুণাবলি থাকে তাহলে আল্লাহ এবং তার গুণের মধ্যে যে সম্পর্ক থাকবে তার তিনটি বিকল্প থাকতে পারে। যথা :
১. একটির অস্তিত্বের জন্য অপরটির মুখাপেক্ষী হবে না।
২. কোনটিই কোনটির মুখাপেক্ষী হবে না। এবং
৩. একটি মুখাপেক্ষী হলেও অন্যটি মুখাপেক্ষী হবে না।
দার্শনিকগণ এর দ্বারা প্রমাণ করেন যে, প্রথম বিকল্প স্বীকার করলে আল্লাহর একত্ব বিনষ্ট হয়। আল্লাহর চিরন্তনতা
দ্বিতীয় বিকল্প দ্বারা রক্ষা করা যায় না। আর তৃতীয় বিকল্প অনুযায়ী যার কারণ দ্বারা আল্লাহ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে । সুতরাং আল্লাহর গুণকে কোন ক্ষেত্রেই গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া দার্শনিকগণ মানবিক গুণাবলির তুলনা করে বলেন, যে জ্ঞান শক্তি ইত্যাদি গুণগুলো আমাদের সত্তার প্রকৃতির সাথে নিহিত নয়, বরং এগুলো আকস্মিক। এ গুণগুলো আল্লাহর উপর আরোপ করলে আল্লাহ এ গুণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বেন। সুতরাং আল্লাহর কোন গুণ নেই । ইমাম আল গাজালি কর্তৃক দার্শনিকদের যুক্তির প্রতিবাদ : দার্শনিকগণ আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে যে
যুক্তি দিয়েছেন তা গাজালি তীব্র বিরোধিতা করেন। নিম্নে গাজালির তীব্র বিরোধিতা যুক্তিগুলো তুলে ধরা হলো :
প্রথমত, গাজালির মতে, দার্শনিকদের যুক্তি কিছু নঞর্থক প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই নয়। গুণসমূহের সমস্যার সাথে আল্লাহর দ্বিত্বতা সমস্যা এক করে দেখা যায় না।
দ্বিতীয়ত, গাজালি বলেন যে, দার্শনিকগণ অবশ্যম্ভাবী সত্তা বলতে কি বুঝাতে চান তা সুস্পষ্ট নয়।
তৃতীয়ত, গাজালির মতে, অবশ্যম্ভাবী সত্তার অস্তিত্ব এবং এর কোন গ্রহণকারী কারণ নেই তা দার্শনিকগণ যুক্তিসংগতভাবে প্রমাণ করতে পারেন নি।
চতুর্থত, দার্শনিকগণ যেভাবে আল্লাহকে গুণারোপ করার মাধ্যমে তাকে অভাবী ভাবা হবে বলে মনে করেন তা সংগত নয় । কারণ আল্লাহ হলো প্রথম কারণ । প্রথম কারণ সৃষ্ট নয় ফলে তার কোন অভাবও নেই। সুতরাং গাজালি বলেন
যে, দার্শনিকদের মতবাদ যুক্তিযুক্ত নয়।
গাজালির বিরুদ্ধে ইবনে রুশদের মত : আল্লাহর গুণ সম্পর্কে ইবনে রুশদ তার “Tahafut al Tahifut” নামক গ্রন্থে গাজালির মতবাদ ও দার্শনিকদের মতবাদকে পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে এটার ব্যাখ্যা দেন। যেমন-
প্রথমত, ইবনে রুশদের মতে, আল্লাহ সাতটি গুণের দ্বারা বিশেষিত। গুণ সাতটি হলো জ্ঞান, জীবন, শক্তি, ইচ্ছা, শ্রবণ, দর্শন ও কথা। মানুষের মধ্যেও এসব গুণ রয়েছে, তবে তা সীমিত আকারে। আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলির সম্পর্কের তিন ধরনের ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে। যথা :
১. আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকার করা, মুতাজিলা সম্প্রদায় এ অবস্থা গ্রহণ করেছেন।
২. এসব গুণকে সর্বাত্মক পরিপূর্ণতা হিসেবে গ্রহণ করা।
৩. এসব গুণকে অতিবর্তী অর্থে গ্রহণ করা এবং মনুষ্যজ্ঞানের অতীত বলে মনে করা। এ গুণাবলি অজ্ঞেয়তার পর্যায়ভুক্ত ।
দ্বিতীয়ত, পবিত্র কুরআন আল্লাহর গুণাবলি স্বীকার করে এবং ঘোষণা করে যে তাঁর গুণাবলি অতুলনীয়। সাধারণ মানুষ কুরআনের বর্ণনানুযায়ী বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ দেখেন, শোনেন ও বলেন। দার্শনিকদের উচিত নয় সাধারণ লোকদের সামনে এসব বিষয় ব্যাখ্যা করা। সুতরাং মুতাজিলা ও আশারিয়া উভয় গোষ্ঠীর মতবাদ ত্রুটিপূর্ণ। ইবনে রুশদ বলেন, আল্লাহর গুণাবলির ক্ষেত্রে কুরআনে বর্ণিত গুণাবলি স্বীকার বা অস্বীকার না করে সেগুলোর সহজবোধ্য অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এসবের দার্শনিক ব্যাখ্যা অবশ্যই গোপন রাখতে হবে।
তৃতীয়ত, আল্লাহর কার্যাবলি পাঁচটি প্রধান কাজে সীমিত করা যায়। যথা : সৃষ্টি, নবী-রাসূল প্রেরণ, ভাগ্য নির্ধারণ,
ন্যায়বিচার ও হাশরে পুনরুত্থান। এগুলো আল্লাহ এবং জগৎ ও মানুষের সম্পর্ক নির্দেশক। জগতের ঐক্য ও বৈচিত্র্য একজন দূরদর্শী সর্বজ্ঞানী আল্লাহর অস্তিত্বের নির্দেশক। কার্যকারণ বিধিও এ জগতের স্রষ্টাকে নির্দেশ করে। ইবনে রুশদের
মতে, কৃত্রিম বস্তুতে যিনি কারণ থেকে কৃতকে আলাদা করতে পারে না। তিনি শিল্প ও শিল্পীর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতে সক্ষম নয়।
চতুর্থত, ইবনে রুশদ মনে করেন কোন সমন্বয় অস্তিত্বের মতো নয়। অর্থাৎ যে অর্থে সমন্বিত গুণাবলিকে চিরন্তন বলা যায়, সে অর্থে অস্তিত্বকে কোন গুণাবলি বলা সম্ভব নয়। মূলত অস্তিত্ব কোন গুণই নয়। যদি অস্তিত্বকে গুণ বলা হয়, তবে ধরে নিতে হবে এর নিজস্ব সারসত্তা রয়েছে। তবে সমন্বিত গুণাবলির মধ্যে কোন গুণাবলিকে সারসত্তা সম্পন্ন বলা
চলে না। রুশদের মতে, আল্লাহ একটি পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্বশীল সত্তা, তিনি কোন যুগ্ম সত্তা বা সমন্বয় নয়। ফলে আল্লাহর গুণাবলি তাঁর সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়।
পঞ্চমত, ইবনে রুশদের মতে, আল্লাহর গুণাবলি আল্লাহর সত্তার মধ্যে এমনভাবে অঙ্গীভূত যে, তাকে পৃথক করে দেখার অবকাশ নেই। এসব কোন অর্জিত গুণাবলি নয়। যেমন- কোন মানুষ গুণাবলি অর্জন করে। এগুলো কোন আরোপিত গুণাবলিও নয়, যেমনটিভাবে মানুষের উপর গুণাবলি আরোপ করা হয়
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, ইবনে রুশদের মূল উদ্দেশ্য হলো দার্শনিকদের মতবাদ ও গাজালির মতবাদকে সমন্বিত করার চেষ্টা করা। তার ধারণা দার্শনিকগণ ও গাজালি উভয়ই আল্লাহর অসীমত্বকেও একত্বকে রক্ষা করতে চেয়েছেন। তবে যেভাবে ইবনে রুশদ আল্লাহর গুণকে মানবিক গুণাবলি থেকে পৃথক করেছেন এবং
তাঁর সত্তার অন্তর্নিহিত গুণ বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুবই যুক্তিসংগত। সুতরাং এক্ষেত্রে তার মতবাদের গুরুত্ব অপরিসীম।