অথবা, ইতিহাস কী? ইতিহাসের কী কী বৈশিষ্ট্য তোমার চোখে পড়ে লিখ।
অথবা, ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, ইতিহাস বলতে কী বুঝ? ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ইতিহাস মানবসমাজের দর্পণস্বরূপ। ইতিহাসের মাধ্যমে মানুষ তার আত্মপরিচয় ও অতীত কার্যাবলি সম্পর্কে অবগত হতে পারে। ফলে মানুষ অতীতের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা হতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পথ চলার দিক নির্দেশনা পায়, যা জাতীয় জীবনে অত্যন্ত অপরিহার্য। অতীত ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণই ইতিহাস। সূর্যোদয়কে বাদ দিয়ে যেমন সূর্যাস্ত কল্পনা করা যায় না, তেমনি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বাদ দিয়ে ইতিহাস কল্পনা করা যায় না। তাই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। অন্যদিকে বলা যায়, আদিকালে মানুষ গুহাবাসী ছিল। কিন্তু সময় সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে মানুষ কীভাবে বর্তমান সভ্যতায় এসে পৌঁছেছে তার ধারাবাহিক বিবরণই হলো ইতিহাস।
ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য : ইতিহাস হলো মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতার সঞ্চিত খনি। ইতিহাসের মাধ্যমে আমরা একটি জাতির অতীত সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে জানতে পারি। ইতিহাসের মূল বৈশিষ্ট্য হলো সমাজব্যবস্থার রাজনীতি,
আইনকানুন, অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়ার দ্বারা নির্দিষ্ট সমাজের প্রকৃত রূপ বিশ্লেষণ করা। ভৌগোলিক ও পরিবেশভেদে নানা দেশ, নানা জাতির বিচিত্র কাহিনি ইতিহাসে স্থান পায়। তবে দেশ, কাল, জাতি, বর্ণ বিভেদে সকল ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য কিন্তু একই রূপ নয়। নিচে ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১. তথ্যনির্ভরতা : ইতিহাসের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তথ্যনির্ভরতা। ইতিহাস রচিত হতে হলে প্রথমে কতকগুলো উৎস বা তথ্যের সংগ্রহ থাকতে হবে এবং তথ্যের জোগাড় করে তার উপর ভিত্তি করেই ইতিহাস রচনার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ উৎস বা তথ্য ছাড়া ইতিহাস রচনা করা অসম্ভব।
২. অনুসন্ধানমূলক : ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তথ্যের উপর নির্ভর করে তার অনুসন্ধান। কারণ অনুসন্ধান ব্যতীত তথ্যের সঠিকতা যাচাই করা সম্ভব নয়। ইতিহাসের ইংরেজি প্রতিশব্দ History যা এসেছে গ্রিক শব্দ Historia থেকে। এ History শব্দের অর্থ সযত্ন অনুসন্ধান। তাই ইতিহাস রচনা করতে হলে অবশ্যই অনুসন্ধান করতে হবে।
৩. আত্মোপলব্ধিমূলক : আত্মোপলব্ধিমূলক বৈশিষ্ট্য ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আত্মোপলব্ধি এর অর্থ হচ্ছে নিজেকে জানা। যারা নিজেকে জানে না তারা কখনো উন্নতি করতে পারে না। ইতিহাস হচ্ছে আত্মোপলব্ধির মূল চাবিকাঠি। কারণ ইতিহাসের পাতা থেকে ইআমরা জাতির তথ্যাবলি সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পারি। আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে ইতিহাস অতীতের গৌরবদীপ্ত প্রপঞ্চকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে তাদেরকে নব চেতনায় উদ্দীপিত করে।
৪. সর্বজনীনতা : সর্বজনীনতা হচ্ছে যা সবার নিকট গ্রহণযোগ্য। কোনো ইতিহাস রচনা করতে হলে অবশ্যই তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। অর্থাৎ ইতিহাসের কোন স্থান, কাল, পাত্র, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারীভেদে পার্থক্য হবে না। তা সকলের নিকট সমভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আর এ সর্বজনীনতা হচ্ছে ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
৫. নিরপেক্ষতা : ইতিহাসকে অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। একটি নিরপেক্ষ ইতিহাস একমাত্র নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকই রচনা করতে পারেন। তাই নিরপেক্ষতা ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নিরপেক্ষতা ইতিহাসকে অন্যান্য বিষয় থেকে আলাদা করে রেখেছে। এই নিরপেক্ষতার জন্যই ইতিহাস কখনো স্বৈরাচারী শাসকদের পক্ষে আবার গণতান্ত্রিক সরকারেরও গুণগান করে না। এটা মাঝামাঝি পর্যায় থেকে মানুষের মধ্যে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।
৬. ধারাবাহিকতা : ধারবাহিকতা হচ্ছে ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য
। প্রতিটি বিষয়েরই ধারবাহিকতা বজায় রাখা উচিত। ধারাবাহিকতা বজায় না থাকলে কোনো বিষয়ে ছন্দ পতন ঘটে। তখন ঐ বিষয়ে সাফল্য ধরে রাখা অসম্ভব। ইতিহাসের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি। কারণ ইতিহাসে বর্ণিত যে কোনো ব্যক্তি, জাতি বা দেশের বর্ণনা অবশ্যই ধারাবাহিক হতে হবে।
৭. সঠিকত্ব : ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর সঠিকত্ব বজায় রাখা। কোনো ইতিহাস যদি সঠিকভাবে রচিত না হয়, তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। গ্রহণযোগ্য ইতিহাস রচিত না হলে তা স্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় এবং ইতিহাসই একদিন হারিয়ে যায়। ইতিহাস যেহেতু যুগ যুগ ধরে টিকে আছে, তাই এর সঠিকত্ব অবশ্যই থাকা উচিত। সঠিক ইতিহাসই পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে।
৮. পরিবর্তনশীলতা : মানব সভ্যতার সৃষ্টির পর থেকে পৃথিবী পরিবর্তন হচ্ছে বার বার। অর্থাৎ পৃথিবী পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে ইতিহাসকে অবশ্যই পরিবর্তনশীল হতে হবে। নয়তো ইতিহাসকে রক্ষা করা যাবে না। মানবজীবনের বিবর্তন, ক্রমোন্নতি ও বৃহৎ আন্দোলনের ক্ষেত্রে যখন কোনো ব্যক্তি
অবদান রাখেন, ইতিহাস ঠিক তখনই তার প্রতি বিশেষ মনোযোগী ও আগ্রহী হয়। যেহেতু মানবসমাজ পরিবর্তনশীল,তাই ইতিহাসও পরিবর্তনশীল।
৯. মানবজাতির ক্রমবিকাশের বিবরণ : ইতিহাস হলো মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের বিবরণ। এর মাধ্যমে মানবজাতির ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানা যায়। মানবজাতির ক্রমবিবর্তনের ধারাবাহিক বিবরণ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকে।
১০. অতীতের তথ্য বিবরণী : ইতিহাস মানবজাতির ঘটনাবহুল অতীত ও বৈচিত্র্যময় কার্যকলাপ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে। ফলে অতীত সম্পর্কে জানা সহজ হয়। মানবজাতির অতীত জীবনের যাবতীয় তথ্য উপাত্ত ইতিহাস থেকে সংগ্রহ করা যায়।
১১. নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে : ইতিহাস মানুষের নৈতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে তোলে এবং ইতিহাসের মাধ্যমে ভবিষ্যতে চলার পথ সহজ করে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ নৈতিক জীবনযাপনে এগিয়ে আসে। নৈতিকতা বর্জিত কাজের কোনো সূফল আমরা ইতিহাসে দেখতে পাইনি।
১২. বিবর্তনবাদের বিবরণ : কিভাবে মানুষ বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান স্তরে এসে পৌঁছেছে, তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র সম্মুখে তুলে ধরে ইতিহাস।
১৩. দেশপ্রেম জাগ্রত করে : ইতিহাস মানবসমাজকে নিজ দেশ, জাতি, সমাজ, কৃষ্টি ও রাষ্ট্রীয় জীবন সম্পর্কে অবহিত করে, যা মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশের অতীত গৌরব সম্পর্কে গৌরববোধ করতে শেখায়।
১৪. আবেগ বর্জিত চিন্তার উন্মেষ : ইতিহাসের তথ্য চয়ন, বিচারবিশ্লেষণ, সংযোগ ও সম্বন্ধকরণের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সুশৃঙ্খল ও নিরপেক্ষ আবেগ বর্জিত চিন্তার উন্মেষ ঘটে।
১৫. বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শের সাথে পরিচয় : ইতিহাস মানুষকে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের পরিবর্তে সার্বিক বিশ্বজনীনতা, মানব কল্যাণ ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার সুবাদে বলা যায় যে, ইতিহাস অর্থ হলো অতীতের গবেষণা। তবে এ গবেষণার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। কারণ যদি ধারাবাহিকতা বজায় রেখে পাঠ করা হয় তাহলে তা সমাজ গঠনে বিরাট সহায়ক হবে। কারণ মানুষ যদি কিছু জানতে চায় তাহলে তার আগে তাকে নিজেকে জানতে হবে। আর এ নিজেকে জানার মাধ্যম হলো ইতিহাস।