অথবা, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে কী? এ সম্পর্কে মুসলিম চিন্তাবিদ বিশেষ করে জাবারিয়া ও কাদারিয়াদের মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, জাবারিয়া ও কাদারিয়াদের ইচ্ছার স্বাধীনতা বিষয়ক মতবাদের পার্থক্যমূলক ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে জাবারিয়া ও কাদারিয়াদের মতবাদের সম্পর্ক আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : স্বাধীন চিন্তা বলতে বুঝায় কোন পূর্ব ধারণা ছাড়াই নিজের বুদ্ধি ও বিবেকের সমন্বয়ে নিজস্ব.চিন্তাধারাকে। মানুষ পৃথিবীর নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে কিংবা ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি তার চিন্তাকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে, কিন্তু এর দ্বারা স্বাধীন চিন্তা করা হতে সে কখনো বিরত থাকে না। আর থাকে না.বলেই সে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জানতে চায়। জানতে চায় পৃথিবীর উৎপত্তি, জীবনের মূল্য, সৌন্দর্য ও নানাবিধ মৌলিক বিষয়াবলি সম্পর্কে। আর এ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে দর্শন। মানুষের স্বাধীন চিন্তাশীল মানস তাকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছে। তাই চিন্তার ইতিহাসে স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে কাদারিয়া ও জাবারিয়াদের মত : কুরআনে যেমন আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার নির্দেশক আয়াত রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত আয়াত। যারা কুরআনে আল্লাহর
সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করে যেসব আয়াত সেসব আয়াতের ভিত্তি করে ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেন তারা ‘জাবারিয়া’ নামে পরিচিত। কিন্তু তারা যেসব আয়াত মানুষের দায়িত্ব কর্তব্যের কথা বলে সেগুলো এড়িয়ে যায়। আবার কাদারিয়া আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার নির্দেশক আয়াতকে এড়িয়ে গিয়ে মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত আয়াতগুলোকে প্রামাণ্য হিসেবে গণ্য করে। তাই তারা মনে করে, মানুষ স্বভাবতই স্বাধীন। নিম্নে প্রথমে কাদারিয়া ও পরে জাবারিয়া মত আলোচিত হলো :
ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে কাদারিয়া মত : কাদারিয়া তাদের মতের সপক্ষে কুরআনের কিছু বিশেষ আয়াতের উদ্ধৃতি দেয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, “আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আল্লাহ যখন কোন জাতির বিপদ চান তখন তা না হওয়ার নয় এবং তিনি ছাড়া আর কোন সাহায্যকারী নেই।”(১৩ : ১১)
“নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর, যাতে তিনি মন্দ কর্মীদেরকে তাদের কর্মের প্রতিফলন দেন এবং সৎ কর্মীদেরকে দেন ভালো ফল । ” (৫৩ : ৩১) “যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার তলদেশ দিয়ে
নির্ঝরিণীসমূহ প্রবাহিত । আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন।” (২২ : ১৪) জাবারিয়া কুরআনের যেসব আয়াত ঐশী ইচ্ছার অনপেক্ষবাদ বা Absolutism এর কথা বলে সেসব আয়াতের উপর তাদের মতবাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। কাদারিয়ারা মানুষকে অদৃষ্ট তথা চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণবাদ হতে মুক্ত করে ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতার কথা বলে এবং মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছেন। মানুষ যে তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী তা সুন্দরভাবে কাদারিয়া মতবাদে ফুটে উঠেছে। শুধু তাই নয়, কাদারিয়ারা মানুষের উপর তার কাজের ভার তুলে দিয়ে মানবজীবনের নৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছে। কাজের নিয়ন্তা হিসেবে ভালোমন্দ বা ন্যায় অন্যায়ের ফলাফল মানুষের উপর বর্তায়। কিন্তু উগ্রপন্থি কাদারিয়ারা এমন মত পোষণ করেন যা প্রকারান্তরে নৈতিকতার ভিত্তিকেই শিথিল করে। মানুষের অবাধ স্বাধীনতা মানুষের জীবনাবৃত্তিকে জাগ্রত করে। কেননা ইচ্ছার স্বাধীনতা বলতে অবাধ স্বাধীনতা বুঝায় না। এটি স্বেচ্ছাচারের নামান্তর। আর এ ধরনের স্বাধীনতার অপপ্রয়োগে সমাজের রীতিনীতি হুমকির সম্মুখ
ীন হয়ে পড়ে এবং মানবসমাজ হয়ে পড়ে বিশৃঙ্খল ও ভারসাম্যহীন। কাদারিয়ারা বলেছেন, সবকিছু যদি আল্লাহর ইচ্ছানুসারে হয়, তাহলে মানুষকে তার কাজের জন্য দায়ী করা চলে না। মানুষ একটি নৈতিক সত্তা। এদিক দিয়ে তাদের মতে, পাশ্চাত্য দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের সাথে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। কান্টও নৈতিক দিক দিয়ে ইচ্ছার স্বাধীনতাকে স্বীকার করেছেন।
ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে জাবারিয়া মত : জাবারিয়া তাদের মতবাদের পক্ষে কুরআনের ঐসব আয়াতের কথা বলেছেন, যেখানে আল্লাহর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
“তিনি প্রত্যেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং তার ভাগ্য নির্দেশ করে দিয়েছেন।” (২৪২) “বল, আল্লাহই সাম্রাজ্যের অধিকারী, যাকে ইচ্ছা তিনি রাজ্য দান করেন। যাকে ইচ্ছা তিনি রাজ্যচ্যুত করেন। তার হাতেই আছে মঙ্গল ভাণ্ডার।” “আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি প্রদান করবেন, কেননা আল্লাহই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ” (২৪ ২৮৪) জাবারিয়ারা মূলত অদৃষ্টবাদী। প্রাক ইসলামি যুগের আব্বাসীয় চিন্তাধারা তাদের চিন্তাধারায় প্রতিফলিত হয়েছে। তাদের মতে, প্রতিটি ঘটনা আল্লাহ পূর্বনির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং সে পূর্বনির্ধারণের মাধ্যমে প্রতিটি ঘটনা সংঘটিত হয়। অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোন ঘটনা ঘটে না। আর তাই মানুষের কৃতকর্মের জন্য কোন শাস্তি হতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, জাবারিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন উমাইয়া শাসকবর্গ। উমাইয়৷ শাসকদের অনেকেই ছিলেন দুষ্কৃতিপরায়ণ। সম্ভবত নিজেদের কুকর্মের যৌক্তিকতা দেখার জন্য এরা মুরজিয়াদের সমর্থন করেন। পরে তারা জাবারিয়াদের সমর্থন করেন। কেননা এর দ্বারা তারা তাদের নিজেদের কুকর্মকে ঐশী আদেশ বলে চালিয়ে দিতে পারে।
জাবারিয়া ও কাদারিয়া মতের মূল্যায়ন : ইসলামের ইতিহাসে জাবারিয়া ও কাদারিয়া উভয়ই ধর্মতাত্ত্বিক. সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। উভয়ের মূল উৎস হলো কুরআন ও হাদিস। তবুও কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যায় তাদের মধ্যে প্রভেদ লক্ষণীয়। জাবারিয়া আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায় বিশ্বাসী। তারা অদৃষ্টবাদ ও পূর্বনির্ধারণবাদে বিশ্বাসী। তারা আল্লাহর সর্বময় কর্তৃত্ব ঘোষণা করতে গিয়ে পরোক্ষভাবে আল্লাহকে মানুষের পাপকার্যের অংশীদার হিসেবে প্রতিপন্ন করেন। অপরপক্ষে, কাদারিয়া মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা ও কর্মের ক্ষমতায় বিশ্বাসী। তাদের মতে, মানুষ যে কাজ করে সে তা নিজের দায়িত্বেই করে থাকে। এজন্য আল্লাহকে কোনভাবেই দাবী করা চলে না। অর্থাৎ মানুষ তার কর্মের নিয়ন্ত্রক হিসেবে তার কর্মের জন্য জবাবের সম্মুখীন (Responsible)। অন্যকথায়, মানুষ তার কর্মের নিয়ন্ত্রক।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে কাদারিয়ারা ও জাবারিয়ারা চরম মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু আমরা একটু খেয়াল করলে দেখতে পাব যে, আমরা জাগতিক বস্তু দ্বারা কোন কোন সময় সীমাবদ্ধ হলেও সে তার চিন্তাজগতে একচ্ছত্র স্বাধীনতা ভোগ করে। তাই বলা যায়, আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা রয়েছে, আবার নেই । এ মত আমরা পরবর্তীতে মুতাজিলা ও আশারিয়াদের মধ্যে দেখতে পাই ।