অথবা, শিক্ষাদর্শন বা সমাজনীতি দর্শন সম্পর্কে ইকবালের চিন্তাধারার বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, ইকবালের শিক্ষাদর্শন বা সমাজনীতি সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ইকবালের শিক্ষাদর্শন বা সমাজনীতি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দাও।
অথবা, ইকবালের শিক্ষাদর্শন বা সমাজনীতি সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে আল্লামা ইকবাল বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। তিনি মুসলিম দর্শনে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক ও পাশ্চাত্যের বস্তুবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। তিনি পাশ্চাত্যের সেসব দিক গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন, যেগুলো ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থি ছিল না। ইসলামি শিক্ষার যে দৃষ্টিভঙ্গি তা পুনর্জাগরণে তার অবদান অপরিসীম। তাই অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন আল-গাজালির পর যদি এমন কোন চিন্তাবিদ থেকে থাকেন যিনি মুসলিম দর্শনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি হলেন আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল ।
ইকবালের শিক্ষাদর্শন : দর্শন জগৎ ও জীবনের মৌলিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। শিক্ষা হলো সেরূপ একটি মৌলিক বিষয়, যা নিয়ে দার্শনিকরা আলোচনা করেছেন। আল্লামা ইকবাল হলেন একজন সমকালীন মুসলিম চিন্তাবিদ, যিনি সামাজিক নীতি ও শিক্ষার মৌলিক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ইকবালের দর্শনের একটি বিশেষ দিক হলো অধ্যাত্মবাদ। আর অধ্যাত্মবাদের একটি বিশেষ দিক হলো অহং বা খুদী। আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হলো
কাজের মাধ্যমে শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির বিকাশ সাধন এবং জগৎ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা গঠন। আমরা জানি, প্রতিটি মানুষের রয়েছে অপার সম্ভবনা। তিনি মনে করেন যে, একজন মানুষের যখন আত্মসত্তা বা অহং এর বিলুপ্তি ঘটে, তখন তাঁর আর কিছুই থাকে না। আর তাই খুদী বা অহং এর বিলুপ্তি হলো ইসলামের পরিপন্থি। পারিপার্শ্বিকতার সাথে নিয়ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে খুদীর বিকাশ সম্ভব। লক্ষণীয় বিষয় এ যে, ইকবালের আধ্যাত্মবাদ বা খুদী দর্শন জীবনবিমুখ; সংসার বিরাগী কিংবা নিষ্ক্রিয় জীবনধারার সমর্থন করে না, বরং বলা যায় ইকবাল সক্রিয় জীবনযাপনের কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন যে, সার্থক জীবন দর্শন, কর্মবিমুখ জীবন দর্শন হতে পারে না। আর এ কারণেই তিনি সংগ্রামমুখর জীবন হতে সরে দাঁড়ানোর নীতিকে গ্রহণ করতে পারেন নি। ইকবাল জগৎকে দেখেছেন
প্রতিনিয়ত বিকাশমান একটি অবস্থা হিসেবে। জগৎ স্থির নয়। আর তাই আমাদের উচিত নিয়ত পরিবর্তনের সাথে খাপখাইয়ে নেওয়ার কৌশল আয়ত্ত করা, যার মাধ্যমে এ পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান দৃঢ় হয়। অর্থাৎ, তিনি অবিরাম সাধনা ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে জগৎকে একটি আদর্শ সমাজে পরিণত করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তাঁর মতে, মানবজীবন নিছক কল্পনাবিলাসী নয়; সুষ্ঠু ও কর্মময় জীবনযাপন মানবজীবনের অন্যতম আদর্শিক লক্ষ্য ।
ক্রিয়াপরতা বা কর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণ : ইকবাল মুসলিম সমাজের সাফল্যহীন অবস্থা দেখে চিন্তিত হন। তিনি মুসলমানদের এ দীনহীন অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য মুসলিম জাতিকে সর্বপ্রকার বিবাদ ও ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ইসলামের সাম্য মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্যের আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণীত হওয়ার উপদেশ দেন। তিনি আরও বলেছেন, মুসলমানদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা এবং অধঃপতনের জন্য তাদের নিষ্ক্রিয়তা ও কর্মবিমুখতা মূলত দায়ী। এজন্য তিনি কাজ করার মানসিকতাকে একটি সৎগুণ বা virtue এবং তার বিপরীত দিক কাজ না করার মানসিকতাকে একটি অসৎগুণ বা vice
বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, একজন সক্রিয় নাস্তিক একজন নিষ্ক্রিয় আস্তিক বা ধার্মিক অপেক্ষা উত্তম। তিনি আরও
বলেছেন, যারা আল্লাহর অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে না তারা নাস্তিক বটে; কিন্তু যারা নিজেদের সত্তা বা অহমের উপলব্ধি করতে
সক্ষম নন; তারা নাস্তিকের চেয়েও অধর্ম। উপরিউক্ত আলোচনা হতে আমর
া বলতে।পারি যে, কর্মতৎপরতাই মানুষের জাগতিক উন্নতির জন্য দরকার তেমনি তা আবার আত্মিক উন্নতি এবং মননশীলতা বিকাশের সহায়তা করে। কেননা, কর্মই ধর্ম বা কর্মই সাধনা।
মানুষ স্বাভাবতবই স্বাধীন। কোনকিছু তাকে সীমিত করতে পারে না। কেননা, মানুষ স্বাধীন সত্তার ধারক ও বাহক। সে স্বেচ্ছায় এ অধিকার অর্জন করে থাকে। পৃথিবীতে আমরা প্রতিনিয়ত বিরুপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি। এমন এক সময়।ছিল, যখন মানুষের ছিল না নির্দিষ্ট বাসস্থান। সে সময় সে গুহায় বাস করত। পরবর্তীতে, প্রাকৃতিক বিরুপ অবস্থা হতে বাঁচার জন্য বাস গৃহ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এ থেকে আমরা বলতে পারি যে, জড়জগতের বিরোধী
শক্তিসমূহই মানুষের কার্যের অনুপ্রেরণা। ইকবাল বলেছেন, জগতের এসব বিরোধী শক্তিসমূহের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রামের মধ্যদিয়েই খুদী বা অহং বিকশিত হয়। বাস্তব জীবনে আমরা দেখি যে, জীবনে আমরা বহু ঘাতপ্রতিঘাত এবং সুখদুঃখের সাথে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মিলিয়ে দিয়ে মানুষ তার ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করে। ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ছাড়া মানুষের আত্মিক পূর্ণতা অর্জন সম্ভব নয়।
ব্যক্তিত্বের বিকাশের শর্ত : মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশ কতিপয় বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা বা শর্তের উপর নির্ভর করে বলে ইকবাল মনে করেন, অতীত ইতিহাস ও কৃষ্টিগত ঐতিহ্যর প্রেরণা খুদী বিকাশের পথে সহায়ক। তবে এটা সত্য যে অতীতের অন্ধ অনুকরণ ভবিষ্যতের গতিপথকে রুদ্ধ করে দেয়। তবে সমর্থক দিক দিয়ে দেখলে বলা যায় যে, অতীত ইতিহাস ও কৃষ্টিগত ঐতিহ্যের প্রেরণা খুদী বিকাশের পথে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তাছাড়া সৃজনশীলতা মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ । এ কথা সত্য যে, মানুষ যদি কর্মে নিজেই প্রথম কোন উদ্দেশ্য গ্রহণ করে, তাহলে আল্লাহ তার কাজকে সম্পন্ন করার জন্য সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। আমরা জানি যে, আল্লামা ইকবাল পাশ্চাত্য আধুনিক ও প্রগতিশীল শিক্ষার দ্বারা শিক্ষক আর এর ফলে তার মধ্যে কুসংস্কার ও গতানুগতিকতার স্থান আমরা দেখি না। তিনি মনে করেন যে, নৈতিক ভালোত্ব ও মন্দত্ব কোন বাধ্যবাধকতার।বিষয় নয়। তিনি আরও বলেছেন পরজগতের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ এবং পার্থিব জগতের প্রতি বিরাগ মুসলমানদেরকে পূর্ণাঙ্গ জীবন গঠনে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইকবাল আধুনিক চিন্তাচেতনার প্রতিভূ হলেও সুফিবাদের অর্থনৈতিক শোষণ এবং সমাজবাদের রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের বিরোধী। আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধক অবয়বের জন্য তিনি পাশ্চাত্যের সমালোচনা করেন। তবে তিনি সমাজতন্ত্রের সামাজিক ন্যায়বিচারকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখেন। আর এজন্য তাঁর মতে, তাকে যদি কোন রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়, তাহলে।প্রথমেই তিনি তাকে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করবেন সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বার্থে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আল্লামা ইকবাল ইসলামকে মূল আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং কুরআনের জ্ঞানকে বিশুদ্ধ সত্যের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেন। ইসলামি চিন্তা ও চেতনার মধ্যে তিনি প্রকৃত জীবনের সন্ধান পান। আর তাই তাঁর দর্শনে ইসলামি ভাবধারা কেন্দ্রবিন্দুকে অবস্থান করেছে। তিনি মনে করেন, ইসলামকে গভীরভাবে অধ্যয়ন
করে মুসলমানদের উচিত খুদী বা অহংকে জাগ্রত করা এবং এর মাধ্যমে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা। তিনি ইসলামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ পাশ্চাত্য, ধ্যান-ধারণা গ্রহণের শিক্ষঅ প্রচার করেন। মুসলিম চিন্তা ও মানস গঠনে তার শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার শিক্ষা দর্শনের মূল ভিত্তি হলো তার খুদীতত্ত্ব।