অথবা, ইউরোপে পুঁজিবাদ বিকাশের অন্যান্য কারণসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : সমাজবিজ্ঞানিক আলোচনায় পুঁজিবাদ একটি কেন্দ্রীয় প্রত্যয়। সামন্তবাদের পতনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। পুঁজিবাদ আধুনিক যুগের সূচনা করে। তাই আধুনিক সমাজ ধারণার সাথে পুঁজিবাদ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নগরায়ণ এবং শিল্পায়ন বিকাশের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। তাই নগরায়ণ ও শিল্পায়ন ব্যতীত
পুঁজিবাদের কথা ভাবাই যায় না।
ইউরোপে পুঁজিবাদ বিকাশের অন্যান্য কারণসমূহ (Other factors of capitalism display in Europe) : ইউরোপে পুঁজিবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লিখিত কারণসমূহ ছাড়াও আরও কিছু কারণ রয়েছে। নিম্নে সংক্ষেপে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. সামন্তবাদের অবসান : সামন্তবাদ ভূমিদাসকে শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সামন্তপ্রভুরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করত। স্বাধীন ব্যবসায়ী শ্রেণীর উদ্ভব, ভূমিদাসদের মাঝে রাজার উদ্যোগে জমি বণ্টন, সামন্তপ্রভুর ক্ষমতা হ্রাস প্রভৃতি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সামন্তবাদের অবসান ঘটে এবং পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে।
২. ব্যক্তিগত মালিকানা : ইউরোপে পুঁজিবাদ বিকাশের একটি অন্যতম কারণ হলো ব্যক্তিগত মালিকানা। ব্যক্তিগত মালিকানা উদ্ভবের ফলে ক্ষুদ্র পুঁজিপতিরা বৃহৎ পুঁজি গঠনের সুযোগ লাভ করে।
৩. বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব : ব্যক্তিগত মালিকানার পথ ধরে ইউরোপে বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। এ বুর্জোয়া শ্রেণী ব্যবসায় বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর পুঁজির মালিক হয়ে যায় এবং নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপন করে, যা বৃহৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হতে থাকে।
৪. বণিক শ্রেণীর উদ্ভব : ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসারের মধ্য দিয়ে বণিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। এ বণিক শ্রেণী ব্যবসায় বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল ধনসম্পদের মালিক হয়ে উঠে এবং পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে ।
৫. ঔপনিবেশিক নীতি : ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো উপনিবেশ নীতি অবলম্বন করে বিভিন্ন দেশ থেকে ধনসম্পদ আহরণ করে ধনসম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। এভাবে পুঁজিবাদ বিকাশলাভ করে।
৬. মুক্ত বাণিজ্যিক শহরের উৎপত্তি : শহর গড়ে উঠার ফলে কুটির শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রয়ের বাজার সৃষ্টি হয়। পণ্য বিক্রয়ের স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে বাণিজ্যিক শহর বা গঞ্জ। শহরে বহুসংখ্যক ক্রেতাবিক্রেতার উপস্থিতি পুঁজিবাদ বিকাশে সহায়তা করে।
৭. যান্ত্রিক কলাকৌশল আবিষ্কার : পুঁজিবাদ বিকাশের প্রাক্কালে বৈজ্ঞানিক ও যান্ত্রিক কলাকৌশল আবিষ্কারের ফলে কলকারখানায় অভাবনীয় পরিবর্তন আসে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। এর ফলে শিল্পপণ্যের বাজারজাতকরণ ও মুনাফা অর্জন সহজ হয়ে উঠে, যা পুঁজিবাদ বিকাশে সহায়তা করে।
৮. কাগজের মুদ্রার প্রচলন : পূর্বে যেখানে পণ্যের জন্য পণ্য বিনিময়ের রীতি প্রচলিত ছিল, সেখানে পণ্য বিনিময়ের জন্য সোনা ও রুপার মুদ্রার প্রচলন হয়। কিন্তু দূরদেশে এগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়া ছিল সমস্যাবহুল। কাগজের মুদ্রার প্রচলন ঘটলে সহজে বহনযোগ্য সুবিধা পাওয়া যায়, যা দ্রুত পুঁজি বিকাশে সহায়ক ছিল।
৯. উদার দর্শন নীতি : প্রকৃতপক্ষে ইউরোপের অর্থনীতি ছিল কৃষিপদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। সে যুগের ধ্যানধারণা ও যুগদর্শন পুঁজি বিকাশের অন্তরায় ছিল। চিন্তাজগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসায় মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার স্থলে উদার দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়। এ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রগতি ও শান্তির লক্ষ্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পুঁজিবাদের উদ্ভব মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিক যুগের সূত্রপাত ঘটায়। ইউরোপে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়, যার প্রত্যক্ষ ফল ছিল পুঁজিবাদের বিকাশ। সমসাময়িককালে পৃথিবীর অপরাপর দেশেও পুঁজিবাদের বিকাশ
ঘটেছিল, যা প্রকৃতিগতভাবে ইউরোপ থেকে ছিল ভিন্ন। বিলম্বে হলেও পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র বর্তমানে পুঁজিবাদের বিকাশ পূর্ণাঙ্গভাবে লক্ষ্য করা যায়।