অথবা, ইউনিয়ন পরিষদের ক্রমবিবর্তন তুলে ধর।
অথবা, ইউনিয়ন পরিষদের ক্রমবিবর্তন বর্ণনা কর।
অথবা, ইউনিয়ন পরিষদের ক্রমবিবর্তন উল্লেখ কর।
অথবা, ইউনিয়ন পরিষদের বিবর্তন ও বিকাশের বর্ণনা দাও।
অথবা, ইউনিয়ন পরিসদের ক্রমবিবর্তন ও বিকাশ সম্পর্কে যা জান লিখ ।
ভূমিকা : বাংলাদেশের পল্লি অঞ্চলে দায়িত্বশীল স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করা হয়েছে। পল্লি এলাকার সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে পল্লির শ্রীবৃদ্ধি সাধন, গণসচেতনতা বৃদ্ধি, দায়িত্বশীল স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো ইউনিয়ন পরিষদের মুখ্য উদ্দেশ্য।
ইউনিয়ন পরিষদের বিবর্তন ও বিকাশ : বাংলাদেশে বর্তমানে আমরা যে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থা দেখতে পাই, তা একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। বিভিন্ন ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে তা আজকের রূপ পেয়েছে। ইংরেজদের শাসনের পূর্বেও আমাদের দেশে গ্রাম এলাকায় স্বায়ত্তশাসনের অস্তিত্ব ছিল। গ্রামের জনসাধারণ মিলিতভাবে গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে তাদের সকল সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের রূপ পেয়েছে। নিম্নে তার ধারাক্রম উল্লেখ করা হলো :
১. ব্রিটিশপূর্ব আমল : ব্রিটিশপূর্ব আমলে গ্রাম্য পরিষদ ছিল গ্রামের প্রশাসনিক এবং বিচার বিভাগীয় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এদেরকে গ্রাম পঞ্চায়েত বলা হতো। মুঘল আমলেও গ্রামীণ ব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা ছিল।
২. ব্রিটিশ আমল : ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক শাসন স্থায়ী করার জন্য তারা প্রথমেই ঐতিহ্যগত গ্রাম সরকারের উপর আঘাত হানে। এ সময়ে নানাবিধ কারণে স্বশাসিত গ্রামীণ ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙে পড়ে। প্রাচীন গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গৌরব হারিয়ে ফেলার ফলে ব্রিটিশ সরকার তাদের শাসন আমলে গ্রামীণ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কতগুলো আইন করেন। এই আইনগুলোর মধ্যে চৌকিদারি পঞ্চায়েত আইন ১৮৭০ এর মাধ্যমে পল্লি অঞ্চলে এক স্তর বিশিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েত নামে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়েছিল। পঞ্চায়েত সদস্যরা চৌকিদারি কর আদায় এবং চৌকিদারদের মাধ্যমে গ্রামের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পঞ্চায়েত সদস্যরা নির্বাচিত হতেন। ১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় স্বায়ত্তশাসন আইনে তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পর্যায়ে সর্বনিম্ন স্তরে ছিল ইউনিয়ন কমিটি। ইউনিয়ন কমিটি কতগুলো গ্রাম নিয়ে গঠিত হতো। বঙ্গীয় গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন আইন ১৯১৯ এর মাধ্যমে দুই স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসনে নিম্নস্তরের ইউনিয়ন বোর্ড ১০টি গ্রাম নিয়ে গঠিত হতো।
৩. পাকিস্তান আমল : ১৯৫৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে চারস্তর বিশিষ্ট স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রবর্তন করেন। ইউনিয়ন কাউন্সিল ছিল গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের মৌলিক স্তর। মৌলিক গণতন্ত্রে স্থানীয় কাউন্সিলের সদস্যগণ নির্বাচকমণ্ডলীতে পরিণত হয়। এ নির্বাচকমণ্ডলী প্রেসিডেন্ট, কেন্দ্রীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করতেন। মৌলিক গণতন্ত্রের আওতায় ইউনিয়ন কাউন্সিলের কার্যাবলি বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
৪. বাংলাদেশ আমল : বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি এক আদেশ বলে মৌলিক গণতন্ত্র আদেশে সকল স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনসমূহের বিলোপসাধন করেন। উক্ত আদেশে ইউনিয়ন কাউন্সিল বাতিল করে ইউনিয়ন পঞ্চায়েত গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে ইউনিয়ন পঞ্চায়েতের নাম পরিবর্তন করে ইউনিয়ন পরিষদ রাখা হয়। ১৯৭৬ সালে জিয়ার সামরিক সরকারের শাসনামলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন অধ্যাদেশ জারি করা হয় এবং ৩ স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যার নিম্নস্তরে ছিল ইউনিয়ন পরিষদ। এর পরবর্তী সরকারসমূহ ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে কিছু কিছু আইনের পরিবর্তন করলেও ইউনিয়ন পরিষদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত রয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সর্ব নিম্নস্তরে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন।