আল কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলার কারণ কী?

অথবা, আল কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলা হয় কেন?
অথবা, আল কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলার কারণ লেখ।
অথবা, আল কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলার যেসব কারণ রয়েছে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধর।
অথবা, আল কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলা যায় কি না, সংক্ষেপে লেখ।
অথবা, কিভাবে আল কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলা হয় সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মুসলিম দর্শনে যে কয়েকজন খ্যাতনামা দার্শনিক অসামান্য অবদান রেখে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন আল কিন্দি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন প্রখর মেধা ও চিন্তাশক্তির অধিকারী। বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করলেও বিজ্ঞান ও দর্শনে তাঁর আগ্রহ ছিল সর্বাধিক। তাঁর মাধ্যমেই আরবদের মধ্যে প্রথাগত দর্শনচর্চার সূত্রপাত হয়।
আল কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলার কারণ : ইসলামে ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক আলোচনা কোন নতুন বিষয় নয়। কুরআন ও হাদিসে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তার তাগিদ বা নির্দেশ রয়েছে। ফলে বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে কাদারিয়া, জাবারিয়া, আশারিয়া, মুতাজিলা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে। মুতাজিলা সম্প্রদায় বুদ্ধিবাদী ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। তারা প্রত্যাদেশকে বুদ্ধির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেছেন এবং ইচ্ছার স্বাধীনতা, আল্লাহর গুণাবলি, কুরআনের নিত্যতা প্রভৃতি সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। কিন্তু সসীম বুদ্ধির সাহায্যে অসীম আল্লাহর সম্পর্কে জানা যায় না। মুতাজিলা সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠে আর একটি সম্প্রদায় যারা আশারিয়া সম্প্রদায় নামে পরিচিত। আশারিয়া সম্প্রদায় অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল হলেও তারা বুদ্ধির ব্যবহার করেছেন; কিন্তু বিরোধ দেখা দিলে বুদ্ধি থেকে সরে এসে প্রত্যাদেশের আশ্রয় নিয়েছেন। মুতাজিলা ও আশারিয়া সম্প্রদায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও তাদের চিন্তাধারায় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির অপ্রতুলতা রয়েছে। তবে তাদের চিন্তাধারায় ধর্মতত্ত্বকে প্রতিপাদনে স্বাধীন চিন্তার ধারাহিকতা পরিলক্ষিত হয়। মুতাজিলা সম্প্রদায়ের বুদ্ধিবাদী চিন্তার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে ফালাসিফা সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এ ফালাসিফা সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের মধ্যে আল কিন্দি অগ্রগণ্য। তিনিই প্রথম চিন্তাবিদ যিনি দর্শনের সমস্যা সমাধানে দার্শনিক পদ্ধতির প্রয়োগ করেন। তিনি জগতের উৎপত্তি সম্পর্কিত তত্ত্ব আলোচনা করেন এবং সমস্যা সমাধানে তিনি ধর্মতত্ত্বকে ছাড়িয়ে যান। তিনি দর্শনচিন্তায় পাশ্চাত্য দার্শনিকদের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছেন। জগৎ ব্যাখ্যায় তিনি প্লটিনাসের ‘Theory of Emanation’ দ্বারা প্রভাবিত হন এবং কুরআন ও হাদিসের আলোকে তিনি তা ব্যাখ্যা করেন যা মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাঁর পূর্বে আর কেউ স্বাধীন চিন্তার আলোকে দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন নি। দার্শনিক পদ্ধতির ব্যবহারের কারণে এবং প্রথম মুসলমান দার্শনিক হিসেবে আল কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাশ্চাত্য দর্শনে থেলিস যেমন পৌরাণিক কাহিনীর পরিবর্তে বিচার ও বুদ্ধির মাধ্যমে জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যার জন্য “জনক” হিসেবে পরিচিত; তেমনি আল কিন্দি ধর্মতত্ত্বের ঊর্ধ্বে গিয়ে দার্শনিক পদ্ধতির আলোকে জগতের ও জীবনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। আর এ কারণেই তাঁকে মুসলিম দর্শনের জনক বলা হয় ।