অথবা, আল্লামা ইকবালের বোধিবাদ বা স্বজ্ঞাবাদ তোমার নিজের ভাষায় লেখ।
অথবা, আল্লামা ইকবালের স্বজ্ঞাবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দাও।
অথবা, আল্লামা ইকবালের স্বজ্ঞাবাদ বর্ণনা কর।
অথবা, আল্লামা ইকবালের স্বজ্ঞাবাদ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর ভূমিকা : মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে আল্লামা ইকবাল (১৮৭৩-১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ) বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। তিনি মুসলিম দর্শনে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক ও পাশ্চাত্যের বস্তুবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। তিনি পাশ্চত্যের
সেসব দিক গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন, যেগুলো ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থি ছিল না। ইসলামি শিক্ষার যে দৃষ্টিভঙ্গি তা পুনর্জাগরণে তার অবদান অপরিসীম। তাই অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন আল-গাজালির পর যদি এমন কোন চিন্তাবিদ থেকেথাকেন যিনি মুসলিম দর্শনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি হলেন আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল।
জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বজ্ঞা : জ্ঞানের উৎস হিসেবে অভিজ্ঞতার বুদ্ধি ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো স্বজ্ঞা। স্বজ্ঞা হলো এমন এক উৎস যার মাধ্যমে আমরা কোন মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি কোনকিছু জানতে পারি। এটি
Subjective বা যিনি এটি আহরণ করে তার উপর নির্ভরশীল।
‘ইকবালের স্বজ্ঞাবাদ : ইকবাল অভিজ্ঞতা, কিংবা বুদ্ধিকে জ্ঞানের যথার্থ উৎস বলে মনে করেন না, বরং তিনি স্বজ্ঞার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকে যথার্থ বলে মনে করেন। কেননা, তার বক্তব্য হলো বাস্তব সত্তার সব দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য এগুলোর প্রত্যেকটিই কোন না কোন পর্যায়ে আবশ্যক হয়ে পড়ে। পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের জন্য তিনি ধর্মীয় প্রত্যাদেশের
প্রয়োজনীয়তাকেও স্বীকার করেন। তিনি বলেছেন, গ্রিক বুদ্ধিবাদ ও মুতাজিলাদের দর্শনের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে,
জ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ রূপের সাক্ষাৎ লাভের জন্য অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও স্বজ্ঞা পরস্পরবিরোধী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক।
প্রকৃত জ্ঞানের উৎস স্বজ্ঞা : ইকবালের মতে প্রকৃত জ্ঞান অভিজ্ঞতার কিংবা বুদ্ধির মাধ্যমে পাই না। বরং প্রকৃত জ্ঞান হলো হৃদয় অর্জিত নিগূঢ় অনুভূতি। সত্তার ও সত্যের পূর্ণ ধারণা লাভের জন্য ইন্দ্রিয়ানুভূতির সাথে যোগ করতে
হয় হৃদয়ানুভূতি। মানুষ হলো ঐশী আলোর প্রতিফলন। আর তাই সে স্বজ্ঞাকে ব্যবহার করে। অর্থাৎ, শয়তান যেখানে বুদ্ধিমান সেখানে মানুষ হৃদয়বান।
স্বজ্ঞা বুদ্ধির চেয়ে উন্নততর : চিন্তার দু’টি দিক আছে বলে ইকবাল মনে করেন, একটি হলো বুদ্ধি অন্যটি স্বজ্ঞা। জ্ঞানলাভের জন্য এ দু’টির প্রয়োজন তবে লক্ষণীয় যে এরা পরস্পরবিরোধী নয়। এদের উৎস এবং উদ্দেশ্য এক। তবে এদের বৈশিষ্ট্যর পার্থক্য রয়েছে আর সেটি হলো স্বজ্ঞা উপলব্ধি করে সামগ্রিকভাবে আর বুদ্ধি সে কাজ করে
বিশ্লেষণের মাধ্যমে বা খণ্ডখণ্ডভাবে। খণ্ডখণ্ড সমগ্রককে সৃষ্টি করে। তাই স্বজ্ঞা বুদ্ধির চেয়ে উন্নতর অবস্থা।
জ্ঞানের ক্ষেত্রে স্বজ্ঞা : ইকবাল মনে করেন স্বজ্ঞাকেই জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রথমে প্রয়োগ করতে হবে। এর মাধ্যমেই বান্দা আল্লাহর নূর বা রহমত লাভের আশা করতে পারে। ইকবাল বলেছেন, এশিয়া এবং বস্তুত সমগ্র প্রাচীন জগতের সংস্কৃতি সমূহ ব্যর্থ হয়েছিলেন এ কারণে যে, তারা সত্তাকে উপলব্ধি করেছিল ভিতর থেকে এবং তারা ভিতর থেকে অগ্রসর
হয়েছিল বাইরের দিকে। এ পদ্ধিতিতে তারা শুধু অসারতা সৃষ্টি করেছিল। তিনি মনে করেন যে, স্বজ্ঞার জ্ঞান অন্যান্য জ্ঞান যেমন প্রত্যক্ষণ, চিন্তন এর অনুরূপ। তবে এ পথ অবশ্যই উন্নত পথ।
মরমি অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্য : ইকবালের স্বজ্ঞাবাদ বিশ্লেষণ করলে আমরা বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য পাই সেগুলো নিম্নে বর্ণিত হলো :
ক. স্বজ্ঞার মাধ্যমে সরাসরি সত্তার পূর্ণ জ্ঞান লাভ : স্বজ্ঞার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ সত্তা সম্পর্কে তাৎক্ষণিক ও সরাসরি লাভ করা যায়। বুদ্ধির মাধ্যমে আমরা শর্তারোপ করে অগ্রসর হয় এবং শর্তারোপ যেখানে সম্ভব হয় না সেখানে সেটি স্তব্ধ হয়ে যায়। আর এখানেই বুদ্ধিজাত ও স্বজ্ঞজাত জ্ঞানের মধ্যে বিস্তার পার্থক্য। তিনি মনে করেন যে, মরমি অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই পরমসত্তা বা আল্লাহর পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা যায়। তবে জ্ঞানের মাধ্যম হিসেবে অন্যান্য অভিজ্ঞতার সাথে মরমিয়া অভিজ্ঞতার তেমন কোন পার্থক্য নেই।
খ. স্বজ্ঞা ব্যক্তিগত নয় বিষয় গত : বুদ্ধি বস্তুজগৎকে মন আরোপিত জ্ঞানের আকার বা সম্বন্ধের মাধ্যমে জানে। বুদ্ধি তাই তার ক্যাটাগরির বাইরে যেতে পারে না। আর সেজন্য সে পরমসত্তাকে জানতে পারে না। অন্তর অনুভূতিতেই পরমসত্তার প্রকৃতি ধরা পড়ে। কাজে দেখা যাচ্ছে যে, যদিও বস্তুজগৎকে দেশ, কালের মাধ্যমে জানা যায়, তবুও পরমসত্তাকে ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমে জানা যায় না। কেবল অন্তরের অনুভবের মাধ্যমে একে জানা যায়।
গ. স্বজ্ঞা হলো অবিশ্লেষণাত্মক সমগ্র : ইকবাল স্বজ্ঞাকে অবিশ্লেষণাত্মক সমগ্র বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন এর মাধ্যমে সত্তা পূর্ণ ও অখণ্ড ঐক্যরূপের প্রকাশিত হয়। মরমিয়া অভিজ্ঞতার ব্যক্তি ও বস্তুকে পৃথক করা যায়
না। সুফি নিজের আত্মাকে মিশিয়ে দেন পরমসত্তার মাঝে। পরমসত্তা তার কাছে এক অখণ্ড অবিশ্লেষণাত্মক সমগ্র হিসেবে
ধরা দেয়। সাধারণ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এরূপ দেখা যায় না। সাধারণ অভিজ্ঞতার কর্তা বা ব্যক্তি এবং বস্তুকে আনয়নের পৃথক করা যায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, ইকবাল যে সজ্ঞাবাদের কথা বলেন, তা মানবীয় জ্ঞানের আকার বা স্বরূপ দেশ ও কালের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়; বরং মানসিক শক্তির হ্রাসবৃদ্ধির সাথে এগুলোর অর্থ পরিবর্তিত হয়। ইকবালের সজ্ঞার ধারণা এমন কিছুকে নির্দেশ করে যা মনোবিকাশের উচ্চতম পর্যায়ে স্বাভাবিক বুদ্ধির ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। এটি বুদ্ধি অপেক্ষা উচ্চতর। অস্তিত্বের উচ্চতর স্তরই হলো সজ্ঞা। এটি মাধ্যম বিহীন, বিশ্লেষণাতীত, বাস্তবধর্মী।
সজ্ঞা সম্পর্কে এরূপ ব্যাখ্যা মুসলিম দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।