অথবা, বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে পরিবারের অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে পরিবারের ভূমিকা বর্ণনা কর।
অথবা, সংক্ষেপে বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের প্রভাব বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে পরিবার ব্যবস্থার প্রভাব অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সেই সুদূর প্রাচীনকাল থেকে এদেশে ঐতিহ্যবাহী পরিবার ব্যবস্থা চলে আসছে। বলা যায়, একসময়ে এদেশের মৌল চাহিদার প্রায় ৯০% পূরণ করত যৌথ পরিবারগুলো। আস্তে আস্তে এ ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে পরিবার ব্যবস্থার প্রভাব :
১. খাদ্য ক্ষেত্রে প্রভাব : খাদ্য হল মানুষের সর্বপ্রথম ও প্রধান মৌল মানবিক চাহিদা। মানুষের বৃদ্ধি, বিকাশ তথা বেঁচে থাকা সবকিছুই খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশে খাদ্যজনিত এই মৌল চাহিদাটি পূরণের ক্ষেত্রে পরিবারের গুরুত্ব ও ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে পরিবার-
ক. উৎপাদনকার্য পরিচালনা : সেই সুদূর ঐতিহাসিককাল থেকেই পরিবারের সদস্যদের খাদ্যজনিত চাহিদা পূরণের জন্য এদেশের পরিবারগুলো খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে খাদ্য উৎপাদনের জন্য চাষাবাদ, ফসল উৎপাদন এবং ফসল সংগ্রহের কাজটি পরিবারই সম্পাদন করে চলছে।
খ. ভোগের ক্ষেত্রে : খাদ্য উৎপাদন যেহেতু পরিবারের মাধ্যমেই সম্পন্ন হতো তাই এসব খাদ্য ভোগের ব্যবস্থাও পরিবারেরই করতে হতো এবং এখনও তা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, পরিবারে সদস্যদের বয়স, শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে তাদের জন্য খাদ্য প্রস্তুত এবং বিতরণের কাজটি অত্যন্ত সুচারুভাবে আমাদের দেশের পরিবারগুলো সম্পাদন করছে। পরিবার
ছাড়াও বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে যদিও ভোগের সুযোগ আছে, তারপরেও খাদ্য বা ভোগজনিত চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে পরিবারের উপযুক্ত বিকল্প এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সৃষ্টি হয় নি।
২. বজ্রক্ষেত্রে প্রভাব : মানুষের লজ্জা নিবারণ, সূর্যের তাপ, শীতের ঠাণ্ডা সর্বোপরি সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। একসময় বাংলাদেশের পরিবারগুলোতে বস্ত্রজনিত সকল চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতো। এখানে পরিবারকেন্দ্রিক তাঁতকল চালু ছিল। পরিবারের সদস্যরা তাদের নিজেদের চাহিদা ও প্রয়োজনমতো এই কলে কাপড় বুনন করত। বিশেষ করে শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজে এ ব্যবস্থাই চালু ছিল এবং এখনও কিছু কিছু পরিবার এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।তবে একথা সত্য যে, বস্ত্রের উৎপাদনের মাধ্যমে পরিবারভিত্তিক যোগান হ্রাস পেলেও মানুষের বস্ত্রজনিত চাহিদা পূরণে
পরিবারের ভূমিকা ও গুরুত্ব এদেশে মোটেই হ্রাস পায় নি। পরিবারেই সন্তান জন্মের পর তার কাপড় তথা পরিধেয় বস্ত্রাদি সরবরাহ করা হয়। বয়স, লিঙ্গানুযায়ী সদস্যদের জন্য উপযোগী ও মানানসই বস্ত্র সরবরাহের দাাায়িত্ব এখন পর্যন্ত এদেশে পরিবারই সম্পূর্ণভাবে পালন করে চলছে।
৩. বাসস্থানের ক্ষেত্রে প্রভাব : বাসস্থান বলতে গৃহ বা ঘরকে বুঝায়।বাসস্থান মানুষের দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তা ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করে থাকে। বাসস্থানের ফলে মানুষ ঝড়, বৃষ্টি, তাপ, শীত, পোকামাকড়, হিংস্ৰপ্রাণী
ইত্যাদির হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে সক্ষম হতো। আমাদের দেশে মানুষের বাসস্থানজনিত চাহিদা পূরণের একমাত্র উপায়ই হল পরিবার।
৪. শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভাব : শিক্ষা হল মানুষের আচরণের এক ধরনের পরিবর্তন, যা সে অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের মাধ্যমে লাভ করে। শিক্ষা মানুষকে, নিজেকে এবং তার পরিবেশ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে শেখায়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা হয়। এদেশের পরিবার ব্যবস্থা শিক্ষাজনিত মৌল চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলছে শত শত বছর ধরে। একসময় এদেশে বর্তমানে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে যা দেখি ও বুঝি তার কিছুই ছিল না এবং তখন মানুষের শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম বা প্রতিষ্ঠান ছিল পরিবার। পরিবারের শিশু কিশোররা তাদের মা-বাবা, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুফা-ফুফু এদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের আদবকায়দা, আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মকর্ম, শালীনতা, শিষ্টাচার, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করত। মোটকথা, একটি শিশুকে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৫. চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রভাব : চিকিৎসা বলতে স্বাস্থ্যসেবাকে বুঝানো হয় । বিভিন্ন ধরনের রোগের হাত থেকে প্রতিকার প্রতিরোধের চাহিদা প্রতিটি মানুষের রয়েছে। অসুস্থতা, রুগ্নতা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাকে রুগ্ন, দুর্বল ও অক্ষম করে তোলে বিভিন্ন রোগব্যাধি। তাই চিকিৎসাজনিত চাহিদাটি একটি মৌল চাহিদা হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের দেশে উড় চাহিদার প্রায় বৃহদাংশই পরিবার পূরণ করে। একজন অসুস্থ রোগীর (বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের) সেবা শুশ্রূষার কাজটি এদেশের পরিবারগুলো অত্যন্ত যত্নসহকারে পালন করে চলছে।
৬. চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রে প্রভাব : চিত্তবিনোদনের মূলকথা হল Mental refreshment. মানসিক প্রশান্তি আনয়নের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে নতুন প্রাণশক্তির সঞ্চার করার জন্য চিত্তবিনোদনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য বাংলাদেশে একসময়ে চিত্তবিনোদনের একমাত্র উৎস ছিল পরিবার। বিশেষ করে পরিবারের শিশু কিশোররা তাদের দাদা-দাদি, নানা-নানি এদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের গল্প, কিচ্ছা, কাহিনী শুনত। পরিবারে আয়োজন করা হতে পুঁথিপাঠ, জারিগান, সারিগানের আসর। এসব আসরে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধকাহিনী, রোমান্টিক উপাখ্যান, ধর্মকথা বর্ণন করা হতো। পরিবারের সদস্যরা এগুলো শুনে আনন্দ লাভ করত। পাশাপাশি পরিবারগুলো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন— ঈদ, কুরবানি, পূজাপার্বণ, নবান্ন উৎসব, বিবাহ ইত্যাদি সম্পাদনের মাধ্যমে চিত্তবিনোদনের সুযোগ সুবিধা
প্রদান করত । এখন পর্যন্ত এদেশের পরিবারগুলো তার সদস্যদের চিত্তবিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম সম্পাদন করে চলছে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এদেশের মানুষের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিবার ব্যবস্থা প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে আছে। পরিবারের এরূপ ভূমিকার ফলে জনসাধারণের শারীরিক, মানসিক, দৈহিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ তুলনামূলকভাবে সহজ হচ্ছে। তবে দেখা যায়, এদেশে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় মানুষের মৌল চাহিদা পূরণের দায়িত্ব এখন বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করছে এবং তারা যথেষ্ট সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে।