আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক বর্ণিত বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর।

অথবা, বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব সম্পর্কে আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংকের তত্ত্বটি আলোচনা কর।
অথবা, এ. জি. ফ্রাঙ্কের বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্বটি আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বিংশ শতাব্দীতে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ধরনের চিন্তাচেতনা, মতবাদ বা তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব এমন একটি তত্ত্ব যা সমসাময়িক সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণে সক্ষম ছিল। বস্তুত বিগত শতাব্দীর ৮০ এর দশকে প্রচণ্ড প্রভাবশালী প্যারাডাইম হলো বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব। এ তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হলেন ইম্যানুয়েল ওয়ালার স্টাইন। তবে এ সম্পর্কে আরো গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেন, সমির আমিন, এ জি ফ্রাংক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব সম্পর্কিত মতামত (Opinion in world system theory) : বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে ফ্রাংকের গবেষণা এবং রচনা বিশ্বব্যবস্থার পরিসরে যোজিত হলেও তাঁর চিন্তা ওয়ালারস্টেইন এবং সমির আমিন থেকে ভিন্ন । ওয়ালারস্টেইনের বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্বের বিরুদ্ধে ফ্রাংকের প্রধান অভিযোগ হচ্ছে এটি ইউরোপ কেন্দ্রিক চিন্তা। তাছাড়া
তিনি ১৫০০ সালকে যে ধনতন্ত্রের উত্থানকাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তা তাঁর তথ্য এবং যুক্তির সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। এমতাবস্থায় ফ্রাংক উল্লেখ করেন, বিশ্বব্যবস্থা ও উন্নয়ন চিন্তা ইউরোপ কেন্দ্রিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভিন্ন এবং এ অনুমান থেকেই ইউরোপ কেন্দ্রিক সমাজ রূপান্তরের একটি ভিন্নধারার পক্ষে মত তৈরি হয়ে যায়।
ফ্রাংকের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউরোপ কেন্দ্রিক চিন্তার সংকীর্ণ পরিসর থেকে সরে এসে মানবকেন্দ্রিক ইতিহাসের চর্চা। এ বিশ্লেষণে ফ্রাংক প্রধানত বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেন। ফ্রাংক বিশ্বব্যবস্থা ও উন্নয়নের যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী তত্ত্ব তুলে ধরেন তা বুঝার জন্য বহু বিষয়গুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
প্রথমত, কোন দেশ বা অঞ্চলের উন্নয়নকে আলাদাভাবে বুঝা সম্ভব নয়। উন্নয়কে বুঝতে হবে বিশ্বব্যবস্থার পরিসরে।
দ্বিতীয়ত, উন্নয়নের ইউরোপ কেন্দ্রিক সমস্ত চিন্তা এবং তত্ত্বকে পরিহার করতে হবে। ইউরোপ কেন্দ্রিক চিন্তা উন্নয়নের বিশাল জ্ঞানভাস এবং তার বাস্তবতাকে বুঝতে বাধা দিয়েছে। ইউরোপ কেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি ফ্রাংক ধনতন্ত্রকে একটি ভিন্ন উৎপাদন পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হন নি। তিনি উৎপাদন পদ্ধতি,
বিবর্তন, রূপান্তর প্রভৃতি প্রত্যয়গুলো বর্জনযোগ্য বলে মনে করেন।
তৃতীয়ত, বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে কাঠামোগত কেন্দ্র, প্রান্ত এবং পশ্চাদভূমির বিভাজন রয়েছে। প্রান্ত অথবা পশ্চাদভূমি থেকে উদ্বৃত্ত কেন্দ্রে পুঞ্জীভূত হয়।
চতুর্থত, বিশ্বব্যবস্থায় বিভিন্ন অঞ্চল বা রাষ্ট্রের মধ্যে আধিপত্যের জন্য প্রতিযোগিতা থাকে যা বিজয়ী অঞ্চল বা রাষ্ট্র কর্তৃত্ব (Hegemony) তৈরি করে।
পঞ্চমত, বিশ্বব্যবস্থায় কর্তৃত্বের নিরন্তর বিকাশ এবং বিলয় ঘটে এবং এ বিকাশ ও বিলয় যুক্ত থাকে উন্নয়নের চক্রের সাথে ।
১৯৯৯ ষষ্ঠত, উন্নয়ন চক্রের বিস্তারের পর্বে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, নগরের বিকাশ ঘটে। নতুন নতুন বাণিজ্যপথ তৈরি হয় এবং অধ্যয়ন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়, বেড়ে যায় সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি। পাশাপাশি কর্তৃত্বের নতুন কাঠামো তৈরি হয়।
সপ্তমত, অর্থনৈতিক বিস্তারের শেষ দিকে মূলধনের অতিরিক্ত কেন্দ্রীভবন, অত্যধিক সঞ্চয়ন এবং উপভোগ তৈরি হয়।
অষ্টমত, অর্থনৈতিক মন্দা বা সংকট যখন সৃষ্টি হয় তখন নির্যাতন, শ্রেণীদ্বন্দ্ব এবং যুদ্ধ বেড়ে যায় । উল্লিখিত বিষয়াবলি ছাড়াও আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক বর্ণিত বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্বটি অনুধাবন করতে হলে, সঞ্চয়ন কর্তৃত্ব এবং কেন্দ্র, প্রান্ত পশ্চাদভূমি প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। কারণ তিনি তাঁর এ তত্ত্বে এ তিনটি বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন।
১. সঞ্চয়ন (Accumulation) : বিশ্বব্যবস্থার পরিধি বিস্তারের জন্য সঞ্চয়ন অপরিহার্য। নিজস্ব তৈরির পথ ধরে বিশ্বব্যবস্থার বিস্তার ঘটে এবং কখনো কখনো তা বাইরের দিকে বিস্তৃতি লাভ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আবিষ্কার বহুমুখী বিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। বিভিন্ন যাতায়াত ব্যবস্থা বিশেষত স্থলপথ, জলপথ, আকাশ পথ বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্বের.সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সঞ্চয়নে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. কেন্দ্র, প্রান্ত, পশ্চাদভূমির সম্পর্ক (Relation’s in centre, periphery and background) : আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক বিশ্বব্যবস্থার মাঝে উদ্বৃত্তের প্রবাহ বুঝাতে গিয়ে কেন্দ্র, প্রান্ত এবং পশ্চাদভূমির ধারণা ব্যবহার করেন। তিনি এসব প্রত্যয়কে কেবলমাত্র ভৌগোলিক অবস্থান হিসেবে দেখেন নি, এ তিনটি প্রত্যয়ের উদ্বৃত্তের উপায়ের সাথে যুক্ত শ্রেণী, নগণ ও সামাজিক সম্পর্ক। পশ্চাদভূমি, প্রাকৃতিক এবং মানবিক সম্পদের উৎস ফলে কেন্দ্র এমনকি প্রান্তও শোষণ করে। কিন্তু পশ্চাদভূমির প্রান্ত থেকে শুধু এক্ষেত্রে ভিন্ন যে, এটি কেন্দ্রের সাথে পুরোপুরি যুক্ত থাকে না। এর নিজস্ব কিছু
সামাজিক স্বাধিকার থাকে। পশ্চাদভূমি উদ্বৃত্ত প্রবাহে সাহায্য করে।
৩. কর্তৃত্ব (Hegemony) : কৰ্তৃত্ব বা Hegemony এর সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে ফ্রাঙ্ক বলেন, “Hegemony is a Hierarchical structure of the accomulation of surplus, among political entitles and their constituent classes, mediated by force.” সাধারণত কেন্দ্র, প্রান্ত এবং পশ্চাদভূমির মধ্যকার যে সম্পর্ক রয়েছে হেজিমনি কাঠামো তাকে দীর্ঘস্থায়ী করে।
কেন্দ্র, প্রান্ত এবং পশ্চাদভূমির উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব করে এবং সেখান থেকে উদ্বৃত্ত আহরণ করে। এ হেজিমনি বা কর্তৃত্ব বিশ্ব ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন পর্বে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে, তবে এর উত্থান ও পতন উভয়ই রয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব একটি সমন্বিত তত্ত্ব, যেখানে অনেকগুলো একক একত্রে কাজ করে। এ বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হলেন আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক। তিনি বলেন, নির্ভরশীলতা এবং বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব আলাদা কোন বিষয় নয়। নির্ভরশীলতা এবং উন্নয়ন ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার সাথে যুক্ত।
বস্তুত ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার প্রসারের মধ্য দিয়ে নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয়।