অথবা, বর্তমান কালের সরকারের শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণগুলো কী কী? আলোচনা কর।
অথবা, তুমি কি মনে কর বর্তমানকালে শাসন বিভাগের ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে?কারণসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : সরকারের তিনটি বিভাগ যথা : আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মাধ্যমেই সরকারের যাবতীয় কার্যাবলি প্রতিফলিত হয়। আধুনিক রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। আর এ কারণেই রাষ্ট্রের বিি পূর্বের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শাসন বিভাগের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আধুনিক যুগে সরকারের কার্যাবলি দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় শাসন বিভাগের ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ : বর্তমান যুগে পৃথিবীর প্রত্যেকটি রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ক্ষমতা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান শতাব্দীর শুরু থেকেই আইনসভার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। পাশাপাশি শাস বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সম্পর্কে বাকার (Prof. Barker) বলেন, ঊনবিংশ শতকে যেন আইন পরিষদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটেছিল বিংশ শতকে শাসন বিভাগের ক্ষমতা সেই গতিতে সম্পন্ন হচ্ছে (If the function of the legislature due to the growth of the cabinet system is the criterion of the nineteenth century the growth of the power of the executive is the criterion of the twentieth century.) শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. সরকারের কার্যাবলির প্রসারতা : আধুনিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সরকারের কার্যাবলির ব্যাপক প্রসারতা। এসব কার্যাবলির শুধু সম্পাদনা শক্তিশালী শাসন বিভাগের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২. আইনসভার সাংগঠনিক দুর্বলতা : আইনসভার সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে জনগণ এ থেকে আস্থা হারাচ্ছে। এ
প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী শাসন বিভাগের উত্থান হচ্ছে এবং শাসন বিভাগের উপর বর্তমানে বেশকিছু আইন প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পিত হওয়াতে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৩. জনকল্যাণমূলক কাজ : আধুনিক রাষ্ট্র হলো জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। বর্তমান সরকারকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা জনস্বার্থ, শিল্প বাণিজ্য প্রভৃতি সেবামূলক কাজ প্রচুর পরিমাণে সম্পাদন করতে হচ্ছে, কিন্তু আইন বিভাগের একার পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শাসন বিভাগের এসব কার্যাবলি সম্পাদন করার জন্য তার ক্ষমতাও সে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. অরুরি অবস্থা ও আন্তর্জাতিক সংকট : আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি প্রভৃতি মোকাবিলার দায়িত্ব শাসন বিভাগের উপর ন্যস্ত। এছাড়া বন্যা, মহামারি, ঝড়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রভৃতি জাতীয় সংকট ও জরুরি পরিস্থিতিতে আইনসভা যথাসময়ে দ্রুত ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বিধায় এসব দায়িত্ব শাসন বিভাগকে পালন করতে হচ্ছে। ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৫. শাসনকার্যে জটিলতা : আধুনিক কালে শাসনকার্য পরিচালনা ক্রমশ জটিল হয়ে পড়েছে। এজন্য প্রতি বছর অনেক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হচ্ছে। এসব শাসন বিভাগীয় বিশেষজ্ঞের হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। এটা শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৬. অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইন : আধুনিক আইনসভা বছরে মাত্র কয়েকবার এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অধিবেশনে মিলিত হয় । ফলে আইনসভার হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে না। তাই আইনসভা যে কোন আইনের মূল কাঠামো প্রস্তুত করে এবং পরিপূর্ণতা দানের বিষয়টি শাসন বিভাগের উপর অর্পণ করে। এগুলোকে ক্ষমতা প্রসূত আইন বা ‘Deligated legislation’ বলে, যা শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে।
৭. ক্ষণীয় ব্যবস্থার কঠোরতা : বর্তমান সংসদীয় শাসনব্যবস্থার আইনসভা মূলত সরকারের ভূত্যের ভূমিকা পালন
করছে। সুসংগঠিত দলীয় ব্যবস্থা, কঠোর দলীয় নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতির ভিত্তিতে মন্ত্রিসতা আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারছে না। তাই সংগত কারণে সাম্প্রতিক কালে আইনসভার ক্ষমতা পাচ্ছে এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৮. যোগ্য নেতৃত্ব : যোগ্য নেতৃত্বই শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত। আইনসভার মধ্য হতে অধিক দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে শাসন বিভাগ তথা মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। মন্ত্রিসভার সদস্যরা আইনসভার তুলনায় অধিক যোগ্য হওয়ায় আইন বিভাগের উপর কর্তৃত্ব করে থাকে। এ কারণে শাসন বিভাগের ক্ষমতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৯. নিয়ন্ত্রণের অসুবিধা : আধুনিক কালে সরকারের কার্য অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় আইন বিভাগ শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় নিচ্ছে। এ কারণেই শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি হচ্ছে আইন বিভাগের উপর, অর্থাৎ শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১১. জনমত গঠন : অতীতে জনমত গঠনে আইনসভা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতো। কিন্তু আইনসভা বর্তমানে এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছে। এ প্রেক্ষিতে বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র প্রভৃতি গণমাধ্যমসমূহ জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ কারণে শাসন বিভাগের ক্ষমতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১২. আইনসভা ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা : প্রধানমন্ত্রী আইনসভা ভেঙে দেয়ার ক্ষমতার অধিকারী। আর সে জন্য আইনসভার সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর অনুরাতে থাকেন। শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার এটাও একটি অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত।
১৪.জাতীয় মুখপাত্র : দেশের প্রধান নির্বাহী সমগ্র জাতির মুখপাত্র হিসেবে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে মথের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সরকারের কার্যক্রম পরিচালনায় তার ভাবমূর্তি বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণেও শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৫. চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা : বর্তমানে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী জনগণের সমস্যা এবং সেগুলোর সমাধান সম্পর্কে সরাসরি সরকারের সাথে আলাপ আলোচনা করে থাকে। ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সাধনের মাধ্যম হিসেবে।আইনসভার গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৮. তথ্য প্রাপ্তির সুবিধা : বর্তমান কালে সরকারের কার্যাবলি অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি আইনসভার কাছে নেই। কোন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত আবার কোনটা করা উচিত নয় এ সম্পর্কিত সব তথ্যই শাসন বিভাগের হাতে রয়েছে। আইন বিভাগ প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে না। পেরে শাসন বিভাগের উপর ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এ কারণে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, আধুনিক কালে বিশ্বের সর্বত্র শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ প্রবণতার জন্য বর্তমান বিশ্বের কাটিল পরিস্থিতিই দায়ী। আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাসও শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত। প্রগতিশীল বিশ্বে বিরাজমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে উত্তরোত্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর এ কারণেই Huntington বলেছেন, “The growth of the executive is an unavoidable phenomenon in modern welfare states.”