আধুনিক পরিবারের পরিবর্তনশীল কার্যাবলি বিশ্লেষণ কর। বাংলাদেশ
সমাজ থেকে উদাহরণ দাও।
অথবা, পরিবারের পরিবর্তনশীল কার্যাবলি আলোচনা কর।
অথবা, আধুনিক পরিবারের পরিবর্তনশীল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আধুনিক পরিবারের পরিবর্তনশীল কার্যাবলি আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : পরিবার একটি ক্ষুদ্রতম প্রাচীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যা সাধারণত বিবাহের মাধ্যমে পিতা- মাতা এবং একক বা একাধিক সন্তান নিয়ে গঠিত। মানুষ সামাজিক জীব, মানুষের সমাজ গঠিত হয় ছোট ছোট কতকগুলো
গোষ্ঠী নিয়ে। এ কারণে মানবসমাজে বহু ও বিভিন্ন ধরনের গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বর্তমান। পরিবার হলো সে গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্রতম ও প্রাথমিক এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান। মূলত পরিবার এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজেদেরকে খুঁজে পাই। এ পরিবারেই আমরা জন্মগ্রহণ করি, লালিতপালিত হই এবং একদিন শেষ
নিঃশ্বাস ত্যাগ করি। পরিবারের পরিবর্তনশীল কার্যাবলি : সমাজ যেমন পরিবারও তেমনি পরিবর্তনশীল। পরিবারের এ পরিবর্তনশীলতার ধারায় বিভিন্ন কার্যাবলিও সংঘটিত হয়ে থাকে। পূর্বের সমাজব্যবস্থায় যে পরিমাণ কাজ
সম্পাদন করা হতো বর্তমান কালের সমাজব্যবস্থায় তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ সম্পাদন করা হয়। নিম্নে পরিবারের পরিবর্তনশীল কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. পরিবারের আকারের পরিবর্তন : শিল্পায়ন ও নগরায়ণ যেহেতু কর্মসংস্থানের কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি করেছে, সেহেতু গ্রামের যৌথ পরিবার থেকে অনেকে নগরে কাজ করতে গিয়ে একক পরিবার গড়ে তুলছে। অনেকে দেশের বাইরে চাকরি
ও ব্যবসায় করতে গিয়ে একক পরিবারে বসবাস করছে। যৌথ পরিবারে তাই ভাঙন দেখা দিয়েছে। এজন্যই পরিবারের আকার এবং কাঠামোয় এসেছে পরিবর্তন।
২. অর্থনৈতিক কাজে পরিবর্তন: বাংলাদেশের গ্রাম সমাজে পরিবারগুলো ভূকেন্দ্রিক বা ভূমিনির্ভর হওয়ায় পরিবারস্থ লোকদের ভৌগোলিক সচ্ছলতা হ্রাস পায়। এখানে কৃষিকাজ ছাড়া এখনো অনেক পেশাভিত্তিক পরিবার রয়েছে, যেমন- তাঁতি, জেলে, কুষকার, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, কামার, গোসালা ইত্যাদি। এসব লোকদের মধ্যে পেশা পরিবর্তনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে শিল্পায়িত সমাজের পরিবারের তুলনায় গ্রামের পরিবারগুলো উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে বেশ নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। আর্থিক পরিবর্তনের আর একটি দিক হলো এখন গ্রামগুলোতে ক্রমশ ছোট ছোট শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। গ্রামের শিক্ষিত যুবকরা কৃষির উপর নির্ভরশীলতা ত্যাগ করে চাকরিবাকরি বা ব্যবসায় বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ফলে গ্রামীণ পরিবারের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় পরিবর্তন ঘটছে।
৩. সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন: গ্রাম সমাজে পরিবারের অন্যতম বিশেষত্ব হলো যে, পরিবারস্থ শিশুরা অগ্রজদের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে থাকে। এর ফলে তাদের উপর অগ্রজদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত দেখা যায়, গ্রামীণ পরিবারগুলোতে শিশু-কিশোরদের আচারব্যবহার ও শিক্ষাদীক্ষা পিতা-মাতার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানের উপর নির্ভরশীল থাকে।
গ্রামের যৌথ পরিবারগুলোতে রক্ষণাবেক্ষণের কাজে দাদা দাদি, নিকট আত্মীয়স্বজন এমনকি প্রতিবেশীরাও সহযোগিতা করেন। যৌথ পরিবারের সন্তানসন্ততিরা আত্মসংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা লাভ করে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বিদ্যাভূষণ বলেছেন, “lt fosters, great virtues like sacrifice, affection, co-operation, spirit of selfless, broadmindedness among its members and makes the family a cradle of social virtues.”
কিন্তু আজকাল শিক্ষাব্যবস্থা বেশ জটিল রূপ ধারণ করায় গ্রামীণ সমাজেও শিক্ষা দানের কাজটি পরিবারের বাইরের শিক্ষালয়গুলো, যেমন- স্কুল, কোচিং সেন্টার, কিন্ডারগার্টেন প্রভৃতি গ্রহণ করেছে। এতিম শিশুদের জন্য
এতিমখানা, অনাথ আশ্রম প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া গ্রামে মেয়েদের ভিতর শিক্ষার প্রসারের ফলে গ্রামীণ নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. অবকাশ যাপন কাজে পরিবর্তন: পূর্বে গ্রামীণ পরিবারের সদস্যদের অবসর বিনোদনের একমাত্র ক্ষেত্র ছিল পরিবার। বর্তমানকালে গ্রামীণ সমাজে পরিবারের বাইরে অবকাশ যাপনের বহুমুখী ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। খেলার মাঠ,
হাটবাজার, গল্পগুজব, সিনেমা, রেস্তোরাঁ প্রভৃতিতে আজকাল গ্রামীণ পরিবারের সদস্যরা অবসর সময় কাটায়। যদিও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার একদিকে গ্রামের পরিবারগুলোর অবকাশ যাপন কার্যগ্রহণ করেছে, অন্যদিকে আবার রেডিও,
টেলিভিশন প্রভৃতির মত জিনিস সরবরাহ করে পরিবারের হাতেই এ কার্যকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
৫. পরিবারের রাজনৈতিক ভূমিকায় পরিবর্তন : গ্রামীণ সমাজে পরিবার ছাড়াও রাজনৈতি বিষয়েও একই কথা বলা চলে। বর্তমানে গ্রামীণ পরিবারের রাজনৈতিক কার্য, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংগঠন।
অভাব নেই। তথাপি নিয়মশৃঙ্খলা, অধিকার, কর্তব্য ও নেতৃত্বের মূল ধারণা পরিবারেই দেওয়া হয়। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের করেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ফলে পরিবারের রাজনৈতিক শিক্ষায় কিছুটা শিথিলতা এসেছে। উল্লেখ্য যে, গ্রামীণ
রাজনীতি বা Village politics দিনদিন জটিলতর রূপ নিচ্ছে। ফলে গ্রামীণ পরিবারে এর নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয়
৬. সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: গ্রামীণ সংস্কৃতি ও চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা নগর সংস্কৃতির তুলনায় অধিকতর ঐতিহ যাতে আবহমান গ্রাম জীবনের স্বরূপ ফুটে উঠে। গ্রামীণ সমাজে শ্রেণি বৈষম্য তুলনামূলকভাবে কম। তাই এখানকার
ধরনের লোক সংগীত, খেলাধুলা ও যাত্রাভিনয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি অভিন্ন চিত্র দেখা যায়। আধুনিক গণযোগ্য। মাধ্যমে নগর সংস্কৃতির প্রভাব গিয়ে পড়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির উপর। ফলে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতি সর্বদাই পরিবর
৭. ধর্মীয় ঐক্যে পরিবর্তন: গ্রামীণ পরিবারের সদস্যগণ সাধারণত একই রকম ধর্মীয় চেতনার দ্বারা প্রতারি পরিচালিত হয়। এছাড়া গ্রাম সমাজের নিরক্ষর লোকের সংখ্যা বেশি থাকায় বিধিবদ্ধ প্রাচীন সামাজিক কুসংস্কারগুলো
টিকে রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সচেতনতার প্রভাব গ্রামের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে কিছু কিছু দেখা যায়।
৮. বিবাহ ব্যবস্থায় পরিবর্তন : গ্রামীণ পরিবারের বিবাহ প্রতিষ্ঠানেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাত্রপাত্রী নির্বা সময় পিতা-মাতা তাদের ছেলেমেয়েদের মতামত গ্রহণ করছেন।
৯. সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন : পরিবারের অন্যতম প্রধান কাজগুলোর মধ্যে সন্তান জন্মদান ও লালন অন্যতম। আদিমকাল থেকে এ কাজ পরিবারের মধ্যেই সংঘটিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিককালে সন্তানের জনন
লালন-পালন প্রক্রিয়া পরিবারের বাইরে অর্থাৎ হাসপাতাল, ক্লিনিক, টেস্টটিউব পদ্ধতি এবং বিভিন্ন ডে-কেয়ার সে শিশু সদন, নাসিং হোমে সম্পন্ন হয়ে থাকে।
১০. পারিবারিক ঐক্যে শিথিলতা : পরিবারের সদস্যরা পারস্পরিক সম্পর্কের দ্বারা আবদ্ধ থাকবে এটাই স্বাচ এখানে সদস্যরা এক অকৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ। কিন্তু এ পারস্পরিক বন্ধন বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে। নি
নগরায়ণ প্রভৃতির প্রভাবে মানুষ কর্মব্যস্ত এবং যৌথ পরিবার ব্যবস্থা থেকে একক পরিবার ব্যবস্থায় পরিণত হয়
পারিবারিক ঐক্যে শিথিলতা দেখা যায় ।
১১. পারিবারিক মূল্যবোধের পরিবর্তন : তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় পারিবারিক মূল্যবোধ অত্যন্ত বেশি লক্ষণীয়। তখনকার সময়ে গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, ছোটদের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য এবং অকৃত্রিম ভালোবাসা?
মূল্যবোধের প্রচলন ছিল। কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার নামে যেসব মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, তাতে পরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বৈকি।
১২. পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম : পরিবারের পরিবর্তনশীল কার্যক্রমের মধ্যে সম্প্রতি পরিবার সম্পর্কে নন পরিকল্পনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের আয়ের সাথে ব্যয়ের সংগতি রক্ষা এবং পরিকল্পিতভাবে পরিবার পরিচালনার
তালিকায় রাখে। আগেকার দিনে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকার কারণে সকল পরিবারে ৮
মানুষের মধ্যে নানারকম উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। পরিবার কাঠামো ছোট রাখার কাজকে তারা নিয়মিত কার্য সদস্য বিরাজ করত। কিন্তু বর্তমানে এ চিত্র দেখা যায় না বললেই চলে। পরিকল্পিতভাবে পরিবার ছোট রাখার।
থেকেই এ পরিবর্তন হয়ে থাকে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পরিবারের কার্যাবলি সময় ও সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে। তাছাড়া পুঁজিবাদ, মুক্তবাজার অর্থনীতি, তথা বিশ্বায়নের প্রভাবে
অধিকাংশ দেশের সমাজকাঠামোর পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশের সমাজকাঠামোতেও এর প্রভাব পড়েছে। বিশ্বে এদেশের পরিবার প্রথায় পূর্বের তুলনায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও বেশি। তাছাড়া বিশ্বে খাদ্য সংকট এবং ধনী-গরিব বৈষম্য ও পরিবারের পরিবর্তনশীল কার্যাবলির জন্য দায়ী।