অথবা, আদিম সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী?
অথবা, আদিম সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বিবর্তনধারার একটি পর্যায়ে মানব অবয়ব সূচিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ের মানুষ ছিল উচ্ছৃঙ্খল, অসহায় ও সভ্যতা বিবর্জিত। তারা ছিল প্রকৃতির হাতের পুতুল, প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণের আওতাভুক্ত। প্রকৃতির রাহুগ্রাস থেকে অবমুক্ত হওয়ার মানসে এবং অস্তিত্বের যথার্থ সংরক্ষণে তারা পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল হয়েছে, হয়েছে যূথবদ্ধ। নির্ভরশীলতার বাস্তবায়নের পথে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে আন্তঃসম্পর্ক। আর এ আন্তঃসম্পর্কের পূর্ণাঙ্গ অবয়বে গড়ে উঠেছে সমাজ ।
আদিম সমাজের বৈশিষ্ট্য : আদিম সমাজের বৈশিষ্ট্য নি েআলোচনা করা হলো :
১. খাদ্যের উৎস : আদিম সমাজ মূলত খাদ্যের জন্য প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রকৃতি অবারিত ফলমূল মুক্তহস্তে প্রদান করত। প্রকৃতির খাদ্যের উপর নির্ভর করেই মূলত তাদের জীবনযাত্রা সূচিত হয়। যদিও তারা পশুপাখিও শিকার করত। এছাড়া একটি মর্মান্তিক বিষয় হাজির হয় যেটা খুবই দুঃখজনক।
২. খাদ্য সংগ্রহের কৌশল : খাদ্য সংগ্রহের জন্য আদিম সমাজের মানুষ বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করত। তাদের ব্যবহৃত জিনিসের মধ্যে কাঠ, হাড়, পাথর উল্লেখযোগ্য। পাথরের ব্যবহার তাদের জীবনায়তনকে অনেকটা সহজ করে তুলেছিল এবং তাদের অস্তিত্বের সংরক্ষণে পাথরের ভূমিকা ছিল। খাদ্য সংগ্রহের বিভিন্ন উপকরণ তাদের সংস্কৃতির নিদর্শন বহন করে।
৩. ভাষার ব্যবহার : আদিম সমাজের মানুষ অধিকাংশ সময় খাদ্যের সন্ধানে ব্যস্ত থাকত। আজকের খাবার পাওয়া লেও আগামীকাল খাবার পাওয়া যাবে কি না সেটা ছিল তাদের কাছে বড় প্রশ্ন। তাছাড়া খাদ্যের অন্বেষণে তাদেরকে হন্যে হয়ে ছুটতে হয়েছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সৃজনধর্মী কোনকিছু করার যথেষ্ট অবসর তাদের মধ্যে ছিল না।
৪. অবাধ যৌনাচার : আদিম সমাজের মধ্যে বিবাহের কোন নিয়মকানুন ছিল না। তাদের মধ্যে অবাধ যৌনাচার প্রচলিত ছিল। তারা তাদের দৈহিক চাহিদা পূরণে জোরজুলুমের আশ্রয় নিত। আদিম সমাজের পিতৃপরিচয়ের বিষয়টি ছিল অস্পষ্ট। সন্তানরা তাদের পিতৃপরিচয় জানত না এবং তাদের মায়েরাও এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল। কেননা নারীরা বিভিন্ন
পুরুষের সাথে সংগমে লিপ্ত থাকত ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
৫. পরিবার : আদিম সমাজের প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবারের কোন অস্তিত্ব ছিল না। তাদের জীবন ছিল বর্বর এবং সভ্যতা বিবর্জিত। বিভিন্ন প্রয়োজনের তাগিদে বিশেষ করে অস্তিত্বের সংরক্ষণে তারা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করত। আর এ দলবদ্ধতা কিছুটা হলেও তাদের মধ্যে স্থায়িত্ব নিয়ে আসে। মূলত তারা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে জীবনযাপন করত।
৬. ধর্ম : নৃবিজ্ঞানী টেইলর (E. B. Tylor) বলেছেন, “আদিম সমাজে ধর্ম ছিল সর্বপ্রাণবাদ। অন্যদিকে, তার শিষ্য বলেছেন মহাপ্রাণবাদ। আদিম সমাজের লোকের মধ্যে ধর্মের বিকাশ ঘটে এবং তাদের মধ্যে আত্মার ধারণা প্রকট হয়। তারা মৃতদেহকে কবর দিত। আদিম সমাজে ধর্মের চর্চা ছিল নানা আচার-অনুষ্ঠানে পরিপূর্ণ।
৭. সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস : আদিম সমাজ ছিল সাম্যবাদী সমাজ। তাই সেখানে শ্রেণী ভেদাভেদ বেশি পরিলক্ষিত হয় না। তবে ব্যক্তিগত যোগ্যতাকে বিশেষ অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা হতো। মূলত স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য সমাজে অনেকেই একটি বিশিষ্ট আসন পেত। তাছাড়া বয়স্ক ও প্রবীণদেরকে সমাজে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হতো।
৮. আগুনের আবিষ্কার : আদিম সমাজের মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে খাদ্যদ্রব্য বিশেষ করে মাংস কাঁচা খেত। কিন্তু এক পর্যায়ে আগুনের আবিষ্কার তাদেরকে মাংস ঝলসে খাওয়ার সুযোগ করে দেয়। আগুনের আবিষ্কার তাদের জীবনের গতি অনেকখানি পাল্টে দেয়। আগুনের আবিষ্কারই তাদেরকে একদিকে যেমন শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা করে, অন্যদিকে জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করে।
৯. কুসংস্কার : আদিম সমাজের মানুষের মধ্যে কুসংস্কার পরিলক্ষিত হয়। ধর্মীয় বিধিনিষেধ তাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল । প্রকৃতপক্ষে কুসংস্কার ছিল তাদের ধর্মের অঙ্গ।
১০. জাদু : জাদুবিদ্যা আদিম সমাজে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ছিল। যারা জাদু দেখাত তাদেরকে দেবতার বংশধর বলে সম্মান করা হতো। সমাজে তাদের এ সম্মান তাদেরকে সমাজকাঠামোর একটি বিশেষ অঙ্গে পরিণত করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, আমাদের সমাজ মূলত আদিম সমাজের নবসংস্করণ। আমরা আজ যে আধুনিক সমাজের সুফল ভোগ করছি তার জন্য আমরা আদিম সমাজের কাছে ঋণী। আদিম সমাজের মানুষ মূলত তাদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন ও জীবনের প্রয়োজনেই দলবদ্ধ হয় এবং তাদের সম্পর্ক সূচিত হয়। এ
সম্পর্কের মাধ্যমেই গড়ে উঠে সমাজ ।