উত্তরঃ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ব্যক্তিগত জীবনে নিজ দেশ, ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং ভাষা থেকে পরিত্যাগ করে অন্যান্য ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ভাষার সাথে একত্র হয়েছেন। তবে, তার উচ্চাশা পোষণের ক্ষেত্রে ভুল পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে নি। তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করেন যে তার উচ্চাশা পোষণ একটি অনুচিত কারণ ছিল। আশার পেছনে কালক্ষেপণ করে কবি, তিনি ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় তার জীবন-অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, এবং এটি তার অদম্য বুদ্ধির প্রতি প্রকাশ পেয়েছে। আশার ছলনায় ভুলে কবি জীবনের অমূল্য সময় ব্যয় করেছেন। যখন তিনি জীবনের এ ফাঁকিটুকু বুঝতে পেরেছেন তখনই প্রশ্ন তুলেছেন
“ আশার ছলনে ভুলি , কী ফল লভিনু , হায় ,
তাই ভাবি মনে ?
জীবন – প্রবাহ বহি কালসিন্ধু পানে ধায়
ফিরাব কেমনে ?
দিন দিন আয়ুহীন হীন বল দিন দিন ,
তবু এ আশার নেশা ছুটিল না , একী দায় ! ”
“এই প্রশ্নের সঙ্গে তিনি প্রকাশ করেছেন যে, জীবনের মৌলিক উপাদান এবং যৌবন সত্তার অতীতে যেতে চলে গিয়ে অবশেষে ফুরিয়ে যাচ্ছে।” তার নিজের চিন্তা ও মনের মাধ্যমে তিনি আবার নিজেকে প্রশ্ন করেছেন
“রে প্রমত্ত মন মম ! কবে পোহাইবে রাতি ?
জাগিবি রে কবে ?”
“ জীবন – উদ্যানে তোর যৌবন – কুসুম ভাতি
কতদিন রবে ? ”
দুর্বাদলের নীরবিন্দুর মতো, ক্ষণস্থায়ী জীবন সত্তার অবস্থানে সবসময় শেষ হয়ে যাবে। আশা মানুষকে স্বপ্ন দেখায়, কিন্তু সে স্বপ্ন দেখে কেবল কাঁদতেই হয়। যতই বিদ্যুৎ পথিককে ক্ষণিকের জন্য আলোকিত করে ধাঁধায় ফেলে, তেমনি মরীচিকা বিচলিত করে পথিককে জলের আশায়; এইভাবে আশারূপী মরীচিকা মানুষের জীবনকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দিকভ্রান্ত করে রাখে।
‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আশার ছলনে ভুলে যে উপলব্ধিগুলি করেছেন তা হল:
জীবনের অসারতা: কবি উপলব্ধি করেন যে জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং অসার। তিনি বলেন, “জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়, ফিরাব কেমনে?”।
আশার প্রতারণা: কবি বুঝতে পারেন যে আশা কেবল একটি প্রতারণা। তিনি বলেন, “এ আশার নেশা ছুটিল না? এ কি দায়!”।
অর্থের লোভের ফলাফল: কবি অনুধাবন করেন যে অর্থের লোভ মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, “বৃথা অর্থ-অন্বেষণে, সে সাধ সাধিতে?”।
যশের তুচ্ছতা: কবি উপলব্ধি করেন যে যশ ক্ষণস্থায়ী এবং তুচ্ছ। তিনি বলেন, “সুগন্ধ কুসুম-গন্ধে অন্ধ কীট যথা ধায়, কাটিতে তাহারে?”।
প্রেমের বিষণ্ণতা: কবি প্রেমের বেদনাদায়ক দিক অনুভব করেন। তিনি বলেন, “জ্বলন্ত-পাবক-শিখা-লোভে তুই কাল ফাঁদে উড়িয়া পড়িলি”।
জীবনের বৃথা অপচয়: কবি বুঝতে পারেন যে তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় আশার ছলনে ভুলে অপচয় করেছেন। তিনি বলেন, “হায়, তাই ভাবী মনে?”।
অনুশোচনা: কবি তার অতীতের ভুলগুলির জন্য অনুশোচনা অনুভব করেন। তিনি বলেন, “এ কি লভিলি লাভ,অনাহারে,অনিদ্রায়?”।
মুক্তির আকাঙ্ক্ষা: কবি আশা-নিরাশার চক্র থেকে মুক্তি চান। তিনি বলেন, “ভুলিবি, মন, কেমনে!”।
উপসংহার: ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তার গভীর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তিনি আশার ছলনে ভুলে তার জীবনের যে বৃথা অপচয় করেছেন তার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেন এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন।