অথবা, ““আত্মজা’ ও ‘করবী’ গাছ বৃদ্ধের জীবনে সমার্থক।”- এই উক্তির আলোকে গল্পের নামকরণ কতটুকু সার্থক তা বিচার কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : নামের মধ্য দিয়েই কোনকিছুর সাথে আমাদের প্রাথমিক পরিচয় ঘটে। শিরোনাম হলো শনাক্তকারী প্রতীক। নামের মাধ্যমে ব্যক্তি বস্তু শিল্পকর্ম বা যে-কোন বিষয়ের মৌল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণও আর্টের অন্তর্ভুক্ত। উৎকৃষ্ট নামকরণ আয়নার মতো শিল্পের মূল উপজীব্য প্রতিফলিত করে। একারণেই সার্থক সাহিত্যকর্মের অন্যতম শর্ত অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ নামকরণ। কবি সাহিত্যিকগণ কাব্যের মূলভাব, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, রূপক বা প্রতীকধর্মিতা, তাঁর জীবনদৃষ্টি প্রভৃতির আলোকে সাহিত্যকর্মের নামকরণ করেন। আমরা ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের নামকরণে সার্থকতা বিচারে এ গল্পের বিস্তারিত আলোচনার একটি প্রয়াস পাব। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ হাসান আজিজুল হকের একটি অসামান্য নির্মাণ। অভিন্ন নামের গল্প-সংকলন ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ (১৯৬৭) গ্রন্থে এটি গ্রথিত। উদ্বাস্তু ছন্নছাড়া এক শরণার্থী বৃদ্ধের জীবনযাপনের মর্মদাহী এক বৃত্তান্ত ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। বস্তুতপক্ষে, বক্ষ্যমাণ গল্পে তেমন কোনো কাহিনি নেই। গ্রামের তিন বখে-যাওয়া যুবক দেশছাড়া এক বুড়োর কন্যাকে ভোগের আকাঙ্ক্ষায় বেরিয়েছে, পৌঁছেছে তারা বুড়োর বাড়িতে এবং অর্থের বিনিময়ে স্ত্রীকে শাসন করে বুড়ো দুই যুবককে পাঠিয়ে দিলো আত্মজার ঘরে-এই-ই হচ্ছে বক্ষ্যমাণ প্রতিবেদনের মৌল ঘটনাংশ। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের ঘটনাস্রোত এগিয়ে চলেছে চরিত্রের মনোলোকে-কখনো এনাম-ফেকু-সুহাস, কখনো-বা কেশো বুড়োর মনোলোকের ক্রমভঙ্গুর ভাবনায় এগিয়ে চলেছে শিল্পিতা পেয়েছে আলোচ্য গল্পের ঘটনাংশ। ইনাম-ফেকু-সুহাস-তিনজনই বখে যাওয়া যুবক, অর্থের বিনিময়ে কেশো বুড়োর আত্মজা রুকু-কে ভোগ করতে তারা রাতের
আঁধারে বেরিয়েছে, উদ্দেশ্য তাদের কেশো বুড়োর বাড়ি। কিন্তু যাত্রাপথে সে-কথা কেউ-ই বলছে না, বলছেন না লেখকও। বরং উল্টোভাবে দেখি নানা ভাবনায়, কখনো এককভাবে, কখনো সম্মিলিত স্রোতে ভগ্নক্রম বিন্যাসে সময় এগিয়ে চলে, এগিয়ে চলে তিন যুবকের শীতরাত্রির অভিসার। রুকুকে ভোগ করার জন্য তিন যুবকের যাত্রা তাদের ভাবনায় কখনোই ধরা দেয়নি-নাকি কৌশলে তাদের মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা দূর করতে চেয়েছেন ভগ্নক্রম কথা-বুননের ছলে? ইনাম-ফেকু-সুহাস কথা বলছে পরস্পরের সঙ্গে-কিন্তু কেউ-ই শুনছে না অন্যের কথা, কারণটা তাদের অন্তর্গত উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা, নাকি সুখ-কল্পনা? ভগ্নক্রম বিন্যাসে, চূর্ণ-চূর্ণ ছবির মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেছেন ইনাম-ফেকু-সুহাসের অন্তর্গত ভাবনায়। কেশো-বুড়ো উদ্বাস্তু মানুষ, দেশ-ছাড়া অসহায় এক পিতা। চরিত্রসমূহের ভাষা থেকে বোঝা যায়, এদের বাস উত্তরবঙ্গে। পক্ষান্তরে কেশো-বুড়ো শুকনো-দেশ (পশ্চিমবাংলা কি?) থেকে এসেছে সে-অঞ্চলে। বোঝা যায় দেশ-বিভাগের পটভূমিতে লেখা এই গল্প। দেশবিভাগ মানুষকে, বাংলার জনসাধারণকে যে-ভাবে বিপন্ন উন্মলিত লাঞ্ছিত করেছে, তারই যেন প্রতীকী রূপ কেশো-বুড়ো। দেশ-ত্যাগের ফলে শূন্য হয়ে গেছে তার ভিতর বাহির-আত্মজাকেও তাই তার কাছে মনে হয়েছে বিষবৃক্ষের বীজ। দেশত্যাগের এই মর্মদাহী যন্ত্রণাকথা উঠে এসেছে কেশো-বুড়োর অন্তর্গত ভাবনায়- “কে আর আসবে এখানে মরতে। জেগেই তো ছিলাম। ঘুম হয় না মোটেই-ইচ্ছে করলেই কি আর ঘুমানো যায়-তার একটা বয়েস আছে-অজস্র কথা বলতে থাকে সে-মনে হয় না, বাজে কথা বকবক করেই যায়। এসো বড্ড ঠাণ্ডা হে, ভেতরে এসো। কিন্তু ভেতরে কি ঠাণ্ডা নেই? একই রকম। দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর বাইরে নেই। সব এক হয়ে গেছে। তোমরা না থাকলে না খেয়ে মরতে হোত এই জংগুলে জায়গায়-বুড়ো বলছে, বাড়ির বাগান থেকে অন্ন জোটানো আ
বার আমাদের কম্ম-হ্যাঃ। ও তোমরা জানো। আমরা শুকনো দেশের লোক বুইলে না-সব সেখানে অন্যরকম, ভাবধারাই আলাদা আমাদের। এখানে না খেয়ে মারা যেতাম তোমরা না থাকলে বাবারা।” সংসার নির্বাহের জন্য কেশো-বুড়ো আত্মজাকে তুলে দিয়েছে ভোগবিলাসী যুবকদের কাছে। রুকু কোনো প্রতিবাদ করেছে কিনা, তার স্বাক্ষর নেই গল্পে। কিন্তু রুকুর মা যে প্রতিবাদ করেছে, মেনে নেয়নি এই অনাচার, তা বোঝা যায় কেশো-বুড়োর এই
ভর্ৎসনা থেকে—‘চুপ, চুপ, মাগী চুপ কর, কুত্তী-এবং সমস্ত চুপ হয়ে যায় সন্দেই নেই, বেঁচে থাকার জন্য আত্মজাকে এইভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে কেঁপে উঠতো কেশো-বুড়োর মর্মলোক। তাই তিন যুবক ঘরে প্রবেশের সময় করবী গাছের বর্ণনা দেন লেখক এই প্রতীকী ভাষ্যে- ‘… সবাই ভিতরে আসতে করবী গাছটার একটা যাল ঝটকানি দেয়।’ কেশো-বুড়ো নিম্নবর্গের মানুষ-আত্মজাকে গ্রামীণ যুবকদের কাছে বিক্রি করে তাকে নির্বাহ করতে হয় সংসার। সুহাস-ফেকু- ইনাম—এরাও নিম্নবর্গ। সুহাসকে নারী-ভোগের জন্য বড় ভাইয়ের পকেট মারতে হয়, ইনাম ভিড়ের মধ্যে মানুষের পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়ে, ফেকুকে দু’টাকা জোগাড় করতে গলদঘর্ম হতে হয়। টাকা নেই বলে ইনাম যেতে পারে না রুকুর ঘরে—এসবই বলে
দেয় ওই চরিত্রগুলোর অবস্থান নিম্নবর্গে। লক্ষণীয়, এসব ক্ষমতাহীন পুরুষ অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছে নারীর কাছে। নিম্নবর্গের সমাজ বাস্তবতায় নারী যে আরো নিম্ন-অবস্থানে, তারা যে ‘তলের তল’ সেকথা রুকু কিংবা তার মায়ের অবস্থা ও অবস্থান অনুধাবন করা যায়। বয়ান-কৌশলে ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ একটি অনুপম সৃষ্টি। গোটা গল্পটাই রচিত হয়েছে, পূর্বেই বলা হয়েছে, ভগ্নক্রম গঠনরীতিতে। চূর্ণ চূর্ণ ভাবনা একত্র কর এখানে নির্মিত হয়েছে এক কালিক সংকটের ছবি। কেশো-বুড়োই কি সেই বিপন্ন ছন্নছাড়া কালের প্রতিনিধি? গল্পের অন্তিমে যে কান্নার ছবি আছে, কেশো-বুড়োর কান্নার ছবি, তাতো দ্বিখন্ডিত দেশের কান্নার ছবি, আর রুকুর ধর্ষিত হওয়া কি দেশ-মৃত্তিকাকে খণ্ড খণ্ড করার রূপক ছবি নয়। গল্পের অন্তিমে কেশো-বুড়োর অন্তঃসংলাপে, তার বিক্ষিপ্ত
মনোকথনে, তার অসহনীয় যন্ত্রণাভাষ্যে, তার বেদনার্ত তার আত্মজার অপমাণে দেশ কি কথা বলে উঠে না। কেঁদে কি উঠে না দেশ- মাতা? তা না হলে অন্তিমে কেন লেকক নির্মাণ করবেন অসামান্য এই ভাষ্য- “তার এখানে আসার কথা আর কিছুতেই ফুরোচ্ছে না সারারাত ধরে সে বলছে, এখানে যখন এলাম—আমি প্রথমে একটা করবী গাছ লাগাই-তখন হু হু করে কে কেঁদে উঠল, চুড়ির শব্দ এলো, এলোমেলো শাড়ীর শব্দ আর অনুভবে নিটোল সোনারঙের দেহ-সুহাস হাসছে হি হি হি… আবার হু হু ফোঁপানি এলো আর এক কথা বলে গল্প শেষ না করতেই পানিতে ডুবে যেতে, ভেসে যেতে থাকল বুড়োর মুখ-প্রথমে একটা করবী গাছ লাগাই বুঝেছ?” ফুলের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ একটি প্রতীকী গল্প। করবী গাছটাই এখানে আত্মজার প্রতীক। করবী গাছে যে বিচি হয়, তা বিষের আধার, −রুকুর তো পিতা কেশো-বুড়োর কাছে চিরায়ত এক বিষকাণ্ড। তাই ঘুরে ঘুরে এ গল্পে আসে করবী গাছের কথা-গল্পের নামকরণ থেকে পরিণতি পর্যন্ত। করবী গাছটাই যে হয়ে ওঠে যন্ত্রণার উৎস, ওটাই যে রুকুর মর্মদাহী অস্তিত্ব কেশো- বুড়োর হার্দিক বয়ানে তা উঠে এসেছে ভয়ানকভাবে- … এখানে যখন এলাম- আমি প্রথমে একটা করবী গাছ লাগাই জন্যে নয়, বুড়ো বলল, বিচির জন্যে, বুঝেছ করবী ফুলের বিচির জন্যে। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে।’
উপসংহার : সার্বিক আলোচনার মাধমে বলা যায় যে, ‘আত্মজাও একটি করবী গাছ’ গল্পের নামকরণ প্রতীকী তাৎপর্যে ঋদ্ধ এবং তা শিল্পসফলও বটে। ‘আত্মজা’ ও ‘করবী গাছ’ বৃদ্ধের জীবনের সমার্থক। সুস্বাদু ফল প্রাপ্তির প্রত্যাশায় মানুষ বৃক্ষরোপণ করে; এ গল্পের বৃদ্ধ রোপণ করেছে করবী গাছ, যার ফল বহন করে তীব্র তিক্ততা- হলাহল। কন্যার সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জ
িত অর্থে জীবন ধারণে বাধ্য হওয়া, তার কাছে করবী গাছের বিষময় ফল ভক্ষণের নামান্তর মাত্র। অন্যার্থে কন্যাটি করবী গাছ, তার অর্জিত অর্থ করবী গাছের ফল, তা গ্রহণ করে তিক্তভাবে বেঁচে থাকা যায় মাত্র- সফলভাবে বিকশিত হওয়া যায় না।