অথবা, আগরতলা মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : আগরতলা মামলা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাজনৈতিক ও প্রশাসনিক টানাপোড়েনের শিকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপট তৈরিতে এ মামলা ও মামলায় বাঙালিদের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। বাঙালির দাবিদাওয়াকে দমন করতে পাকিস্তান সরকার এ মামলা করে।
আগরতলা মামলার বিচার প্রক্রিয়া : পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি ঘোষণা করে ‘পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র উদঘাটিত হয়েছে’। এ ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে ১নং আসামি করে মোট ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং একটি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। এ মামলার সরকারি নাম দেয়া হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’। লোক মুখে এ মামলা আগরতলা মামলা নামে পরিচিতি লাভ করে। এ মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতিপয় সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের সহায়তায় সশস্ত্র উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি ১৯৬২ সালে গোপনে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় যান এবং শচীন্দ্রলাল সিংহ, জওহরলাল নেহেরু এবং লে. কমান্ডার
মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে দেখা করে ষড়যন্ত্র করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এই মামলার নামকরণ করেন ‘ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা।’ আগরতলা মামলার বিচারকার্যের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন কুর্মিটোলায় ক্যান্টনমেন্টের একটি বিশেষ কক্ষে পাকিস্তানি দণ্ডবিধির ১২-ক এবং ১৩১ ধারায় বিচারকার্য শুরু হয়। এ মামলার ১০০ অনুচ্ছেদের চার্জশিট ছিল এবং সাক্ষীর সংখ্যা ছিল মোট ২২৭ জন। যার মধ্যে সরকার পক্ষের ১১ জন। শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন স্যার টমাস উইলিয়াম, আব্দুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান। আর পাকিস্তানি সরকারের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনজুর কাদের ও জেনারেল টি.এইচ. খান। এ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি ছিলেন এস. এ. রহমান, এম. আর. খান ও মকসুমুল হাকিম। ২৯ জুলাই এ মামলার শুনানি শুরু হয়। পাকিস্তানের শাসকদের মামলা সাজানোর কৌশল দেখে বুঝা যায় যে, অভিযুক্তরা দেশকে স্বাধীন করার জন্য গোপনে কাজ করেছিল এবং তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এ কাজে লিপ্ত ছিল। মূলত শেখ মুজিবুর রহমানকে হেনস্তা করা এবং স্বাধীনদেশের স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ করার জন্য এ মামলা করা হয়। পাকিস্তান প্রচার করতে চেয়েছিল ভারতের ইন্ধনে পাকিস্তানকে ভাঙার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। তবে জনসাধারণ জানতো শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা আন্দোলনের নেতা, তাই তাকে ষড়যন্ত্র করেই ফাঁসানো হয়েছে। ফলে ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও অভিযুক্তদের মুক্তির দাবি উঠে। একদিকে অভিযুক্তদের ট্রাইব্যুনালে ফাঁসানোর চেষ্টা চলতে থাকে, অপরদিকে তাদের মুক্তির জন্য আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। আন্দোলনে অনেকে আহত হন অনেকে নিহত হন। আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তান সরকার প্রতিহিংসাবশত মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সার্জেন্ট মোহাম্মদ ফজলুল হককে গুলি করে হত্যা করে। ফলে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে এবং অবশেষে গণআন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মামলা প্রত্যাহার করে সকল অভিযুক্তদের মুক্তি দেয় পাকিস্তান সরকার।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আগরতলা মামলার প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ বিদ্বেষমূলক। টাইব্যুনাল চেয়েছিল মিথ্যা মামলা দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদের ফাঁসিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে মেরে ফেলতে। কিন্তু প্রবল আন্দোলনের মুখে তাদের অপচেষ্টা ও মিথ্যা মামলা ব্যর্থ হয়। প্রতিহিংসাবশত তারা হত্যা করে বাঙালি বীর সন্তানদের ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি।