আগরতলা মামলার কারণ ও ফলাফল বর্ণনা কর।

অথবা, আগরতলা মামলার কারণ ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। এ সময় স্বৈরাচারী সরকার দেশদ্রোহিতার অজুহাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অতঃপর শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করে কুমিল্লা সেনানিবাসে আটক রাখেন। শাসকগোষ্ঠীর অভিযোগ ছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অনুচরবর্গসহ ভারতের সাথে যোগাযোগ করে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল।
আগরতলা মামলা দায়েরের কারণ : নিচে আগরতলা মামলা কেন দায়ের করা হয় তার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. শেখ মুজিবুর রহমানকে দমন : আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তাকে ভয় পেত। তাছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা ভিত্তিক আন্দোলন আইয়ুব সরকারকে নড়বড়ে করে দেয়। এতে ভীত হয়ে আইয়ুব খান মামলার আশ্রয় নেয়।
২. ঐতিহাসিক দিক : পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস হলো সংগ্রাম-আন্দোলন আর অত্যাচার ও নির্যাতন। আইয়ুব সরকার তাই পূর্ব বাংলাকে দমন পীড়ন করার জন্য মামলা দায়ের করেছিল।
৩. আন্দোলন ভীতি : পূর্ব বাংলার জনগণ প্রায়ই আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলনের ডাক দিত। এতে আইয়ুব খান অস্বস্তিবোধ করতো। তাই আইয়ুব খান আন্দোলনকে দমনের জন্য ৩৫ জনের নামে মামলা দায়ের করে।
৪. ছয়দফা : ছয়দফার প্রথম দফা পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন। পূর্ব বাংলার জনগণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করলে আইয়ুব খান তা দমানোর জন্য আগরতলা মামলা দায়ের করেছিলেন ।
৫. সুশীল সমাজের উত্থান : আইয়ুব শাসন আমলে সুশীল সমাজ মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। এ সময় সরকারি ও বেসরকারি অনেক অবসরকালীন ব্যক্তিত্ব আইয়ুব সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। ফলে আইয়ুব সরকার মামলার আশ্রয় নেয়।
৬. ছাত্র আন্দোলন : আইয়ুব শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থায় যে কালাকানুন আঁকা হয়েছিল এর প্রতিবাদে ছাত্র জনতা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়।
৭. ক্ষমতার লোভ : আইয়ুব সরকার দীর্ঘকাল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দমন পীড়ন শুরু করে। এতে কাজ না হলে আইয়ুব সরকার মামলার পথ অবলম্বন করে।
৮. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি : শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা ভিত্তিক আন্দোলন আইয়ুব সরকারকে অতিষ্ঠ করে তোলে। বার বার আন্দোলন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে আইয়ুব অন্য পন্থা অবলম্বন করে মামলা পন্থা বেছে নেয়।
আগরতলা মামলার ফলাফল : পূর্ব বাংলায় আগরতলার মামলা এক বিষফোঁড়া হিসেবে কাজ করে। তাই পূর্ব বাংলার জনগণ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে যা গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। ফলে আইয়ুব সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। যার ফলাফল ছিল পূর্ব পাকিস্তানে সুদূরপ্রসারী। নিচে আগরতলা মামলার ফলাফল আলোচনা করা হলো :
১. আইয়ুব সরকারের পতন : আইয়ুব সরকার আগরতলা মামলা দায়ের করে দমন পীড়নের জন্য। কিন্তু তীব্র আন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার টালমাটাল হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি ও মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয়।
২. মামলা প্রত্যাহার : আগরতলা মামলা দায়ের হলে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এতে জনগণের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ফলে আইয়ুব সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
৩. ইয়াহিয়া ক্ষমতায় আসীন : আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করার পর আইয়ুব ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। এতে তিনি সামরিক শাসন জারি করার প্রস্তুতি নেন কিন্তু তার সহযোগীরা তাতে সাড়া না দেয়ায় তিনি ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ রাতে ক্ ষমতা থেকে অব্যাহতি নেন। পরের দিন ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসীন হন।
৪. শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচিতি বৃদ্ধি : আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ১নং আসামি করা হয়। এতে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য লন্ডন থেকে উকিল আনা হয় যা সমগ্র বিশ্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিচিতি করেছিল।
৫. ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান : আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। এক পর্যায়ে জালিম আইয়ুব খানের নির্দেশে আসাদুজ্জামান, শামসুজ্জোহা প্রভৃতি ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। এতে ছাত্র-জনতা আরো খেপে যায়। এতে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ লাভ করে।
৬. ১৯৭০ সালের নির্বাচন : আগরতলা মামলার প্রত্যাহারের জের ধরে আইয়ুবের পতন ও ইয়াহিয়া ক্ষমতায় আসীন হন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন পূর্ব বাংলার জনগণ রাজনৈতিক অধিকার চায়। তাই তিনি জনগণের ভোটাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা কায়েম করেন।
৭. ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জন : ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবির আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন সবশেষে মহান স্বাধীনতা অর্জন। এভাবে প্রতিটি ঘটনা বা Movement একে অপরের সাথে জড়িত যা স্বাধীনতা অর্জনের সিঁড়ি হিসেবে কাজ করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আগরতলা মামলা পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। আইয়ুব সরকার দমন পীড়নের শেষ অস্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাঙালি জনগণ জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়। এতে আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। অবশেষে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।