উত্তর : ভূমিকা : দাউদ খান কররানীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গের স্বাধীনসত্তা বিলুপ্ত হয় এবং বঙ্গে দাউদ খানের পতনের ফলে আফগানদের প্রায় পঞ্চাশ বছরের সার্বভৌমত্বের অবসান ঘটে। এতদসত্ত্বেও রাজমহলের যুদ্ধের পরেও অনেকদিন বঙ্গদেশ মুঘল-আফগান রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। এ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি
অতিক্রম করতে মুঘলদের আরও দু-দশক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। আকবরের শাসনামলে বঙ্গে বেশ কয়েকজন শাসক
শাসন করেছিলেন।
→ আকবরের শাসনামলে বঙ্গদেশের।শাসনকাল : বাংলা জয় করে সম্রাট আকবর একে একটি সুবায় পরিণত করেন। নিম্নলিখিত সুবাদারগণ আকবরের শাসনামলে বঙ্গদেশের শাসন কার্য পরিচালনা করেন।
১. মুনিম খান (১৫৭৫ খ্রি:)
২. খান-ই-জাহান হুসাইন কুলি (১৫৭৫-৭৮ খ্রি.)
৩. মুজাফফর খান তুরবর্তী (১৫৭৮-৮০ খ্রি:)
৪. রাজা টোডরমল (১৫৮০-৮২ খ্রি:)
৫. খান-ই-আজম মীর্জা আজিজ কোকা (১৫৮২-৮৪খ্রি.)
৬. শাহবাজ খান (১৫৮৪-৮৭) খ্রি.)
৭. রাজ মানসিংহ (১৫৮৭-১৬০৬ খ্রি.)
নিম্নে এসব শাসকদের শাসনকাল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. মুনিম খান : মুনিম খান ছিলেন বঙ্গদেশের সর্বপ্রথম মুঘল রাজপ্রতিনিধি। বঙ্গদেশ ও বিহারকে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অসামান্য। মহামারির কবলে
পতিত হয়ে এ মহান সেনাপতি ৮০ বছর বয়সে ১৫৭৫ সালে তান্ডায় মৃত্যুমুখে পতিত হন।
২. খান-ই-জাহান : খান-ই-জাহানের নাম ছিল হুসাইন কুলি। বঙ্গদেশের শাসক মুনিম খানের মৃত্যুর পর হুসাইন কুলি ১৫৭৫ সালে খান-ই-জাহান উপাধি গ্রহণ করে বঙ্গের সুবাদার নিযুক্ত হন। তিনি টোডর মলের সাহায্যে রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খানকে পরাজিত করেন। আহত সেনাপতিদ্বয় কালাপাহাড় ও কুতলু লোহানীসহ পলায়নকালে দাউদখান ধৃত ও নিহত হন।
রাজমহলের যুদ্ধের ফলে বাংলার আফগান স্বাধীন বংশের লোপ পায় এবং মুঘল শাসনের সূত্রপাত হয়। খান-ই-জাহান তান্ডায় রাজধানী স্থাপন করেন।
৩. মুজাফফর খান তুরবর্তী : খান-ই-জাহানের মৃত্যুর পর বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন মুজাফফর খান তুরবর্তী। তিনি ১৫৭৮ সালে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। পূর্বে তিনি সম্রাট আকবরের একজন অন্যতম সভাসদ ছিলেন। তিনি বাংলায় আকবরের রাজস্বব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হন। এতে সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের মধ্যে বিরোধের সুত্রপাত হয়। তাদের বিরোধ ও বিদ্রোহ দমন করতে ব্যর্থ হয়ে মুজাফফর
খান তান্ডার দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিদ্রোহীরা তান্ডার দুর্গ অবরোধ করে মুজাফফর খানকে হত্যা করে।
৪. রাজা টোডরমল : ১৫৮০ সালে রাজা টোডরমল বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। তিনি তরসুন খানের সহায়তায় বিদ্রোহীদেরকে পরাজিত করে বিহারে পুনরায় মুঘল প্রাধান্য স্থাপন করেন। ইতোমধ্যে বাবা খান কাকশাল অসুস্থ হয়ে পরলোকগমন করলে বাংলায় আবার মুঘলদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে।
৫. মীর্জা আজিজ কোকা : রাজা টেডরমলের পরে মীর্জা৷ । আজিজ কোকা ১৫৮২ সালে খানই-ই-আজম উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। অভিজাত ও বিচক্ষণ মির্জা আজিজ কোকাকে সম্রাট আকবর বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত করেন। তিনি এক প্রকার বিনা যুদ্ধে তান্ডা অধিকার করেন। বিদ্রোহীদের মধ্যে অন্তর্বিরোধ এবং যুদ্ধে কালাপাহাড়ের পরাজয় বাংলার বিদ্রোহী আফগান নেতৃবৃন্দের পতন ঘটায়। মীর্জা আজিজ কোকার বাংলার জলবায়ু সহ্য না হওয়ায় সম্রাট আকবরের অনুমতিক্রমে তিনি বিহার প্রদেশে নিজ জায়গায় ফিরে যান।
৬. শাহবাজ খান : ১৫৮৪ সালে মীর্জা আজিজ কোকা মৃত্যুবরণ করলে আকবর বঙ্গে দক্ষ ও সুযোগ্য সুবাদার শাহবাজ খানকে নিয়োগ
করেন। শাহবাজ খান একজন সমরকৌশলী সেনানায়ক ছিলেন। তিনি তান্ডা হতে প্রথমেই মাসুম খান কাবুলীকে বিতাড়ন করেন।
এজন্য অবশ্য তাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। মাসুম ভাটি অঞ্চলে গিয়ে ঈসা খানের আশ্রয় গ্রহণ করেন।
শাহবাজ খান ঈশা খানের রাজধানী দখলের চেষ্টা করলে ঈশা খান এবং কাবুলী খান।সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করেন। ঈসা খান আত্মসমর্পণ না করলেও।তোষণনীতির মাধ্যমে মাসুম কাবুলীসহ অনেক আফগান নেতাকে
শাহবাজ খান বশীভূত করেন। শাহবাজ খান বীরত্বের সাথে শাসন কার্য পরিচালনা করে অবশেষে ১৫৮৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
৭. রাজা মানসিংহ : ১৫৮৭ সালে শাহবাজ খানের মৃত্যু হলে অল্পদিনের মধ্যেই মানসিংহ বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। মানসিংহ
রাজমহলে মুঘল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে ঈসা বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কিন্তু বিক্রমপুরের নিকটে সংঘটিত যুদ্ধে মুঘল বাহিনী পরাজয় বরণ করে। তবে ঈশা খান জয়লাভ করেও মানসিংহের সাথে শান্তি করেন। ১৬০২ সালে মানসিংহ শ্রীপুরের স্বাধীন জমিদার কেদার রায়কে যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দি করেন এবং ১৬০৪ সালে। অবস্থায় তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। হাজীপুরের জমিদার পুরনমল প্রচুর ধনরত্ন সহ মানসিংহের নিকট বশ্যতা স্বীকার করলে পুরনমলকে তার জায়গিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। অতঃপর পুরনমল
প্রদত্ত সমস্ত উপহার দিল্লির দরবারে আকবরের নিকট প্রেরিত হলে আকবর সন্তুষ্ট হয়ে মানসিংহকে ‘খিলাত’ এবং উপহার প্রদান
করেন। অতঃপর মানসিংহ উড়িষ্যা অভিযানে স্বীয় পুত্র জগৎ সিংহকে প্রেরণ করলে কুতলু খানের হাতে তিনি বিষ্ণুপুরে বন্দি হন। ইতোমধ্যে কুতলু খান পরলোক গমন করলে তার শিশুপুত্রের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী খাজা ঈশা মুঘলদের সাথে এক সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর দান করেন। জগৎ সিংহ মুক্তি লাভ করেন। সন্ধির
শর্তানুযায়ী কুতলু খানের পুত্র সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে। ১৫৯১ সালে রাজা মানসিংহ উড়িষ্যা বিজয় করে বিহারে
প্রত্যাবর্তন করেন। ১৫৯৪ সালে মুঘল সম্রাট আকবর মৃত্যু শয্যায় শায়িত হলে রাজা মানসিংহ আগ্রায় প্রত্যাবর্তন করেন। আকবরের উত্তরাধিকারী সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে তিনি সাময়িকভাবে মাত্র আট মাস বাংলার গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পরিশেষে বলা যায় যে, সম্রাট আকবরের আমলে যে কয়েকজন সুবাদার বাংলায় শাসন কার্য পরিচালনা করেছিলেন তারা সফলভাবেই শাসন করেছিলেন, মূলত আকবরের আমলেই বাংলা পুরোপুরিভাবে মুঘলদের সাম্রাজ্যভুক্ত হয় ।