অথবা, আওয়ামী লীগের ছয়দফা ও যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার মধ্যকার পার্থক্য আলোচনা কর।
অথবা, আওয়ামী লীগের ছয়দফা ও যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার মধ্যে তুলনা দেখাও।
অথবা, যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা ও আওয়ামী লীগের ছয়দফার মধ্যেকার তুলনা সংক্ষেপে লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বেনিয়াদের হাতে চলে যায়। এ বেনিয়া শ্রেণি ভারতবর্ষে প্রায় দুইশত বছর তাদের আধিপত্য বজায় রাখেন। বাঙালিরা বেনিয়াদের শোষণ নির্যাতন থেকে মুক্ত হন ১৯৪৭ সালে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর বাঙালিরা আবার পতিত হন পশ্চিমা শাসক চক্রের রোষানলে। পশ্চিমা শাসক চক্রের রোষানল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য একের পর এক কর্মসূচি ও আন্দোলনের ডাক দেন। ফলে বিভিন্নভাবে বাঙালিরা প্রতিবাদ করেন। তেমনি প্রতিবাদ হলো একটি ১৯৬৬ সালের শেখ মুজিবের ছয়দফা। ছয়দফাকে তুলনা করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের ফল। যেমন- সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ইংল্যান্ডের ইতিহাসে যেমন ম্যাগনাকার্টা, আমেরিকার ইতিহাসে যেমন স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদির সাথে ছয়দফা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্ব দিক নির্ধারণী সূত্র।
আওয়ামী লীগের ছয়দফা এবং যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার মধ্যে তুলনা : ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট যে একুশ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল তাতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ছয় দফা দাবির মধ্যেও স্বায়ত্তশাসনের দাবিই ছিল বেশি প্রকট। তবুও দুই ধরনের দাবি দুই ধরনের প্রেক্ষাপটে পেশ করা হয়। তাই এ দু’টির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য দৃষ্ট হয়। নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে :
প্রথমত, যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা কর্মসূচি ভাষা আন্দোলন তথা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে গৃহীত হয়। অপরপক্ষে, আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছিল, আইয়ুব সরকারের সকল অন্যায় অত্যাচার এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যনীতির অবসানের পটভূমিতে গৃহীত।
দ্বিতীয়ত, ছয়দফা এবং একুশ দফা উভয় ক্ষেত্রেই স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রেক্ষাপট হিসেবে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। একুশ দফায় কেন্দ্রের হাতে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও মুদ্রা এ তিনটি বিষয় রেখে বাকি সব প্রদেশের হাতে ছেড়ে দেওয়ার দাবি দেওয়া হয়। কিন্তু ছয়দফায় প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র ছাড়া অন্যসব বিষয় প্রদেশের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলা হয়। ছয় দফা অনুসারে করধার্যের ক্ষমতা কেন্দ্রকে দেওয়া হয়নি।
তৃতীয়ত, যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার মধ্যে ভাষার দাবি থেকে শুরু করে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রজনতা তথা আপামর জনগণের দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ছয়দফা ছিল মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির দাবি, যদিও এটা সর্বশ্রেণির সমর্থন লাভ করেছিল । ছয়দফায় কেবলমাত্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবিসমূহ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
চতুর্থত, একুশ দফার তুলনায় ছয়দফায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়নের বিষয়টি ছিল অধিকতর কার্যকরী। ছয় দফা অনুসারে প্রদেশগুলো করধার্য, পৃথক বাণিজ্য সম্পর্ক এবং নিজস্ব বৈদেশিক মুদ্রার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ক্ষমতা পায়। কিন্তু একুশ দফার ক্ষেত্রে এরূপ কার্যকারিতা দৃষ্ট হয় না।
পঞ্চমত, একুশ দফায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কথা বলা হয়, কিন্তু আলাদাভাবে আধাসামরিক বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। কিন্তু ছয় দফায় আলাদা আধাসামরিক বাহিনী গঠন করা জোরালোভাবেই বলা হয় ।
ষষ্ঠত, যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার মধ্যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হলেও এটা বাস্তবায়নের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ছয়দফার মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে কার্যকর, অর্থবহ এবং বাস্তবায়িত করার ব্যবস্থা গৃহীত হয়। যেমন- পৃথক অথচ
অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা, মুদ্রা পাচাররোধ অথবা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের অধীনে উভয় অঞ্চলের জন্য অভিন্ন মুদ্রার ব্যবস্থা, বহিঃবাণিজ্যের ক্ষেত্রে আলাদা হিসাব প্রভৃতি।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে ৬ দফা প্রকাশ করা হয়, তা ছিল বাঙালি জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ ঘোষণায় নিহিত ছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবি, অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি, বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদাকে টিকিয়ে রাখার দাবি। ৬ দফা প্রাথমিকভাবে ঘোষণা করার সাথে সাথে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও তা ছিল বাঙালিদের জন্য পরবর্তী আন্দোলনের সাহস যোগানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ দফার মাধ্যমে দেখা যায় ‘৫২ সালে যেমন বাঙালিরা অসাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ দেন, তেমনি ‘৬৬ সালের ৬ দফার ক্ষেত্রেও বাঙালির সে অসাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যে অসাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ দিয়ে বাঙালিরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেন। কিন্তু এখনও প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা স্বাধীনতা আন্দোলনের যে অসাম্প্রদায়িকতা তা কতটা রক্ষা করতে পেরেছি? যদি পেরে থাকি তাহলে তা বাঙালিদের জন্য স্বগর্ভের বিষয়।