অথবা, আইয়ুব খানের শাসনামলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের স্বরূপ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক ভূখণ্ড নিয়ে গঠন করা হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। এ দুটি অংশের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক পার্থক্য ছিল বিস্তর। শুধু ধর্মের উপর ভিত্তি করে এ দুটি অংশকে একত্রিত করে রাষ্ট্র গঠন করা হয়। কিন্তু এ দুটি অংশের মধ্যে অচিরেই সম্পর্কের অবনতি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে শুরু হয় এ দুটি অংশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব।
আইয়ুব খানের শাসনামলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রকৃতি : ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যবর্তী শাসনকালে বাঙালি মন ও মনন পীড়নের স্বীকার হয়েছে বার বার। এ সময় শাসন ক্ষমতায় ছিলেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বৈরি মনোভাব পোষণ করেন। প্রথমে তিনি বাঙালি সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন চালান।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভাষা, সাহিত্য, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, শিল্প, ঐহিত্য প্রভৃতিতে খুব কম মিল ছিল। শুধু মিল ছিল উভয়ের ধর্মই ছিল ইসলাম। পশ্চিম পাকিস্তানে শতভাগ মুসলমান থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৮০ ভাগ মুসলমান ছিল। বাংলা ভাষা ব্যবহারের কারণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে তাদের সাংস্কৃতিক মিল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। আর শুরু থেকেই ভারত-পাকিস্তান বৈরীভাবাপন্ন ছিল। পাকিস্তান সরকার চেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতি বাঙালিদের উপর আরোপ করতে। তারা শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। তাদের এ ধারণা যে, বাংলাদেশের মুসলমানরা হিন্দু-বাংলার সংস্কৃতি দ্বারা বেশি আকৃষ্ট। হিন্দুরা রবীন্দ্রনাথের ভক্ত, নিজস্ব জীবনবোধ ও সংস্কৃতির প্রতি অধিকতর শ্রদ্ধাশীল। তারা উর্দু অপেক্ষা বাংলার প্রতি অধিক অনুরক্ত। ফলে তাদের মধ্যে বিদ্বেষভাব জাগ্রত হয়। সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতি সন্দেহপরায়ণ
হয়ে তারা তাই বাঙালিদের বিজাতীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সাল থেকেই শুরু হয় ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন। আইয়ুব খানের শাসনামলেও সে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর প্রস্তাব করে এবং তা বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেয়। অথচ মাত্র ৭.২ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল উর্দু। অপরদিকে পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষির সংখ্যা ছিল ৫৬.৪০ শতাংশ। বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ তাদের এ অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে। আইয়ুব খান তার পূর্ববর্তী রাষ্ট্রনায়কদের মতো বাংলা ভাষার
প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি বলেন, দুটি পৃথক অঞ্চলের জন্য রাষ্ট্রীয় সংহতি আনয়ন করতে একটি নির্দিষ্ট ভাষার দরকার। সেজন্য তিনি ভাষার সমন্বয় সাধন করার উদ্দেশ্যে রোমান হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে বাংলা একাডেমির উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। তৎকালীন বাংলা একাডেমির পরিচালক সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে ভাষা সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহল
প্রতিবাদ জানায়। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রতিবাদ জানিয়ে খবর ছাপা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগও তীব্র বিরোধিতা করে। ফলে বিরোধিতার মুখে আপাতত আইয়ুব খানের ভাষার উপর আগ্রাসনের সংকল্প ভণ্ডুল হয়। কিন্তু পাকিস্তানের ভাবধারা পুষ্ট এ দেশীয় বাঙালিরা পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে মুসলমানিত্ব প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং পাঠ্য বইয়ে নজরুলের কবিতা প্রবর্তন করা হয়।
আইয়ুব খান এবং তাঁর অনুসারীরা রবীন্দ্রবিদ্বেষী ছিলেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুদের প্রতিনিধি রূপে গণ্য করতেন।
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করে ১৯৬১ সালে । বাংলা একাডেমিকেও জন্মশতবার্ষিকী পালন না করার নির্দেশ দেয়া হয় এবং সংস্কৃতি অঙ্গনে ভীতিসৃষ্টি করতে কেজি মোস্তফা, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখকে গ্রেফতার করে। কিন্তু নিপীড়ন সত্ত্বেও বিচারপতি মাহবুব মোরশেদ এবং অধ্যাপক খান সরওয়ার মোর্শেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী কমিটি। এ কমিটি ছয়দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গঠিত হয় ছায়ানট শিল্পী গোষ্ঠী। সর্বত্র
অনুষ্ঠান উদযাপনের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের চক্রান্ত ভণ্ডুল হয়ে যায় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানিদের ভারত বিদ্বেষ ও বাঙালি সংস্কৃতির উপর নিজেদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা থেকেই তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথ বেছে নেয়। আইয়ুব খানের সময়েও সে প্রচেষ্টা চলতে।থাকে। বাংলা সংস্কৃতিকে ইসলামি সংস্কৃতিতে পরিবর্তন করার প্রয়াস হিসেবে তারা ভাষাকে সবার আগে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু বীরবাঙালি তাদের এ আগ্রাসনকে প্রতিহত করে।