অথবা,আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতির তুলনামুলক আলোচনা কর।
অথবা,আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতির মধ্যে বৈপরীত্য উল্লেখ কর।
অথবা , আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে কী পার্থক্য রয়েছে? আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে কতকগুলো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সংকীর্ণ অর্থে আইন বলতে বুঝায় সার্বভৌম রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক সুনির্দিষ্টভাবে রচিত ও বিধিবদ্ধ এমন কতকগুলো নিয়মকানুন, যা মানুষের বাহ্যিক ও সামাজিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেগুলো আদালত কর্তৃক গৃহীত, স্বীকৃত ও বলবৎ হয়।আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে পার্থক্য আইন সম্পর্কিত এ ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে কতকগুলো বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান। যথা:
১. সংজ্ঞাগত পার্থক্য: আইন হল কতকগুলো মৌলিক বিধিবিধানের সমষ্টি, যা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয়ে থাকে। এটি মানুষের বাহ্যিক দিক নিয়ন্ত্রণ করার সাথে সাথে আইন ভঙ্গের অভিযোগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।। অপরদিকে, কতকগুলো সাধারণ বিধিবিধান নিয়ে প্রথা গঠিত হয়, যা জনগণ স্বেচ্ছায় পালন করে থাকে।
২. উৎসগত পার্থক্য: আইন প্রণয়ন করা হয় কিন্তু শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রণয়ন করা হয় না, ধীরে ধীরে গড়ে উঠে। আইনানুসারে গঠিত আইনসভা কর্তৃক আইন প্রণীত হয়। আইনসভা হল আইনের মূল উৎস। শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো প্রচলিত প্রথাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। তাই উভয়ের মধ্যে উৎসগত দিক থেকে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।
৩. প্রকৃতিগত পার্থক্য: আইন লিখিত থাকে বলে তা মোটামুটিভাবে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হয়। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক
রীতিনীতিগুলো আচারব্যবহার, প্রথা ইত্যাদির ভিত্তিতে গড়ে উঠে বলে তা অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট প্রকৃতিসম্পন্ন। তাই বিভিন্ন লোকে এগুলোর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে। কিন্তু আদালত ছাড়া অন্য কেউ আইনের ব্যাখ্যা করতে পারে না।
৮. ব্যাখ্যাগত পার্থক্য: আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করার ক্ষমতা একমাত্র আদালতের। আদালত ব্যতীত কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারে না। অন্যদিকে, প্রথার ব্যাখ্যা বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে প্রদান করে থাকে।
৯. মর্যাদাগত পার্থক্য: ব্রিটেনের পার্লামেন্টে আইন প্রথার চেয়ে অধিক মর্যাদা ভোগ করে। কেননা আইন প্রথাকে বাতিল করার ক্ষমতা রাখে এবং আইন মান্য করা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক।
১০. স্বীকৃতি ও অনুমোদনগত পার্থক্য: রাষ্ট্র কর্তৃক আইন স্বীকৃত ও অনুমোদিত হয়ে থাকে এবং আইন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সমাজের সকলের আকুন্ঠ সমর্থন রয়েছে। পক্ষান্তরে, প্রথা স্বীকৃত ও অনুমোদিত হয় জনমতের বলে, রাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে প্রথাকে অনুমোদন দেয় না।
১১. প্রাধান্যগত পার্থক্য: ব্রিটেনের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রথার চেয়ে আইনের প্রাধান্য বেশি। কোন কারণে আইন ও প্রথার মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে আদালত আইনকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, প্রথা সম্পূর্ণভাবেই আইনের অনুগত।
১২. প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে পার্থক্য: আইন পরিবর্তনযোগ্য। প্রয়োজন অনুযায়ী এবং সময়ের চাহিদা পূরণে বিভিন্ন সময় নতুন আইন প্রণয়ন ও পুরাতন আইন সংশোধন করে থাকে। কিন্তু প্রথা বা রীতিনীতি ক্রমবিকাশের মাধ্যমে গড়ে উঠার প্রয়োজনে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়।
১৩. প্রক্রিয়াগত পার্থক্য: সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অনুসরণ করে আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু প্রথা বা শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে গড়ে উঠে না।
১৪. মতৈক্যগত পার্থক্য সমাজের সকলেই আইনের ক্ষেত্রে ঐকমত্য পোষণ করে। অপরদিকে, প্রথার ক্ষেত্রে একথা সত্য নয়। কারণ প্রচলিত সকল প্রথাই সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ স্বীকার করে না।
১৫. গতিশীলতার ক্ষেত্রে পার্থক্য: আইনের তুলনায় প্রথা অধিক গতিশীল। কারণ আইন প্রণয়ন সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে সহজেই প্রথা রক্ষা করা সম্ভব।
১৬. আদালতে বলবৎ যোগ্যতাগত পার্থক্য: আইন আদালত দ্বারা সরাসরি বলবৎ করা হয় এবং আইন অমান্যকারীকে শাস্তি ভোগ করতে হয়। অপরদিকে, কেউ প্রথা অমান্য করলে আদালত তাকে শাস্তি প্রদান করতে সক্ষম হয়।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে উপযুক্ত পার্থক্য থাকলেও উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক গভীর। আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য আছে বলে বর্তমানে মনে করা হয় না। Ivor Jennings সহ আধুনিক শাসনতন্ত্রবিদদের মতে, “ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য খুব সামান্যই আছে।” তাই ব্রিটিশ জনগণ আইনকে যেমন শ্রদ্ধা করে ও মেনে চলে, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি বা প্রথাগত বিধানকেও তেমনি শ্রদ্ধা করে ও মেনে চলে।