Download Our App

অসহযোগ আন্দোলন কী?

অথবা, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টিতে ‘৭০ এর নির্বাচনের প্রভাব উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদে এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তান পিপিপি পার্টি দ্বিতীয় স্থান দখল করে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পিপিপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে দুই অঞ্চলের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। নিচে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট
সৃষ্টিতে ‘৭০-এর নির্বাচনের ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টিতে ১৯৭০ এর নির্বাচনি ফলাফলের ভূমিকা : ১৯৭০
সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে মোট মহিলা আসনসহ ৩১৩টির মধ্যে আওয়ামী লীগ লাভ করে ১৬৭টি যার সবকয়টিই ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। অন্যদিকে প্রাদেশিক আইন পরিষদের মোট মহিলা আসনসহ ৩১০টি এর মধ্যে ২৯৮টি আসন লাভ করে। অন্যদিকে পিপিপি ৮৮টি আসন লাভ করে পশ্চিম পাকিস্তানে। ফলে দুটি প্রদেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। নিচে এ ব্যাপারে বর্ণনা করা হলো :
১. ফলাফল প্রত্যাখ্যান : নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পাকিস্তানের অন্যান্য বড় দলগুলো এ ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি করেন যে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো ছয়দফা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ছয়দফায় অনড় থাকে ফলে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়।
২. আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান : ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে এবং পিপিপি পশ্চিম পাকিস্তানে আঞ্চলিক প্রাধান্য লাভ করে। নির্বাচনি ফলাফলে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে এবং পিপিপি পশ্চিম পাকিস্তানে আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। কলে উভয় রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজ নিজ স্বার্থে অটল থাকে।
৩. ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা : নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় স্বাভাবিকভাবেই তারা ক্ষমতা গ্রহণ করবে এবং সরকার গঠন করবে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে টালবাহানা শুরু করে। এর ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা ঘনীভূত হয়।
৪. প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্ব : ‘৭০ এর নির্বাচনের পর প্রধান দুই দল পিপিপি এবং আওয়ামী লীগ আদর্শগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগ ছয়দফা দাবিতে অটল থাকেন অন্যদিকে পিপিপি ছয়দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নাকচ করেন।
৫. অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত : ১৯৭০ সালের নির্বাচনি ফলাফলে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঢাকায় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। কিন্তু ভুট্টো চেয়েছিল আওয়ামী লীগকে পাশ কাটিয়ে সরকার গঠন করতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ
শাসনতন্ত্র প্রণয়নে কঠোর অবস্থান নিলে বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টোর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ পরিস্থিতিতে ১ মার্চ হঠাৎ বেতার ভাষণের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানে জনতা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং পাকিস্তান সরকারের এরূপ আচরণের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলে।
৬. বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন : পাকিস্তান সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র ও শক্তিশালী হয়। এ বাঙালি জাতীয়তাবাদীগণ পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে।
৭. পাকিস্তানের বিভক্তি : ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলে। দুই অঞ্চলের ফলাফল জনগণের মতাদর্শ ও অবস্থান স্ব-স্ব অঞ্চলের পক্ষ অবলম্বন করে। যার ফলে পাকিস্তানের বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠে।
৮. স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি : ‘৭০ সালের নির্বাচনের পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বসাধারণ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার শপথ গ্রহণ করেন এবং
পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানকে গভীর রাজনৈতিক সংকটে ফেলে। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ নিজ প্রদেশের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় অটল থাকে। ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক সংকট থেকে অসহযোগ আন্দোলন এবং সর্বশেষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার জনতা। জন্ম হয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। এর পিছনে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে ‘৭০ এর নির্বাচনি ফলাফল।