অথবা, অর্থনীতির বিভিন্ন মতবাদ সম্পর্কে বর্ণনা কর।
উত্তর : প্রারম্ভিক কথা। সময়ের পরিবর্তনের সাথে মানব জীবনের অর্থনৈতিক কাজ-কর্ম ও চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ফলে অর্থনৈতিক মতবাদেরও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেক প্রতিভাবান বিষয়টির উপর নিজস্ব মতবাদ ব্যক্ত করতে চেষ্টা করেন। তাই অ্যারিষ্টটল হতে এ যাবৎ অর্থনীতির বিষয়বস্তু ও সংজ্ঞার উপর যত মতবাদ প্রদান করা হয়েছে এদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশী পরিলক্ষিত হয়। এমন কি সমকালীন অর্থবিজ্ঞানীদের চিন্ত ধারাতেও বিভিন্নতা লক্ষণীয়। আলোচনার সুবিধার্থে অর্থনৈতিক মতবাদকে মোটামোটি তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
১. ক্লাসিক্যাল মতবাদ (Classical Concept).
২. নিও ক্লাসিক্যাল মতবাদ (New Classical Concept),
৩. আধুনিক মতবাদ (Modern Concept),
১. ক্লাসিক্যাল মতবাদঃ অর্থনীতির ক্ল্যাসিক্যাল মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন ব্রিটেনের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ এ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith), ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর “Weallth of Nation” গ্রন্থে তিনি অর্থনীতিকে ‘সম্পদের বিজ্ঞান’ বলে আখ্যায়িত করেন।
অর্থাৎ, কিভাবে সম্পদ উৎপাদন, বন্টন, ও ভোগ করা যায়, সম্পদের বিজ্ঞান তা আলোচনা করে। এ মতবাদ অনুযায়ী সে ব্যক্তি একজন অর্থনীতিক মানুষ যার শুধু বস্তুগত চাহিদা রয়েছে এবং বস্তুগত দ্রব্য সামগ্রির যোগান দ্বারা যার চাহিদা পুরণ হয়।
মতবাদের গুরুত্ব: মানব কল্যাণের চেয়ে সম্পদ আহরণের উপর মতবাদ অধিক গুরুত্ব আরোপ করে।
অনুসারিবৃন্দ: অর্থনীতির এ ক্লাসিক্যাল মতবাদের অনুসারিগণ ছিলেন-
১. জন স্টুয়ার্ট মিল (Jean Stourt Mill).
২. জে. বি. সে. (J. B. Say). ৩. ওয়াকার (Waker).
৪. টমাস রবাট ম্যালথাস (Tomus Robert Melthus).
সময়কাল: অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ এবং উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক।মতামত:
(ক) অর্থনীতির জনক হিসেবে এ্যাডাম স্মিথের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “An Inquiry into the Nature and Causes of the wealth of Nations (1776), সবার কাছে সুপরিচিত’ গ্রন্থটির নাম সংক্ষেপে অনেক সময় বলা হয় “The wealth of Nation)। তাঁর মতে, “অর্থশাস্ত্র হল এমন একটি বিজ্ঞান যা জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি ও কারণ অনুসন্ধান করে।”
(খ) এ্যাডাম স্মিথের পর ১৭৯৮ সনে রেভারেন্ড টমাস ম্যালথাস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ” An Essay on the principle of population as it affects the future improvements of socity” এতে তিনি ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের মতামতকে সমর্থন করেন।
(গ) ম্যালথাসের পর যে গ্রন্থটি ক্লাসিক্যাল তত্ত্বকে ধারণ করে, সেটি হলো ১৮০৩ সনে প্রকাশিত Treatise on political Economy”-এই গ্রন্থের প্রণেতা হলেন ফরাসী অর্থনীতিবিদ জীন ব্যাপষ্টিস্ট সে (J. B. Say).। সেই গ্রন্থে বিখ্যাত ‘সের বিধি স্থান পায়।
(ঘ) ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির অন্তর্গত অপর একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল ১৮১৫ সনে প্রকাশিত ডেভিড রির্কাডোর “The principles of political Economy and Taxation.” এই গ্রন্থটি অনেক সময় এ্যাডাম স্মিথের “The wealth of Nation’ এর সঙ্গে তুলনীয় বলে মনে করা হয়। এই গ্রন্থে উপকরণ দাম প্রাধান্য পায়।
(ঙ) পরবর্তী গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হল জন স্টুয়াট মিলের “Principle of political Economy (1848) গ্রন্থটি দুটি খন্ডে বিভক্ত। গ্রন্থের মুখবন্ধে মিল উল্লেখ করেন তিনি “The wealth of Nation কে যুগোপযোগী ও প্রসারিত করে তাঁর গ্রন্থ রচনা করার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর মতে, “অর্থনীতি সম্পদের উৎপাদন ও বণ্টন সংক্রান্ত ফলিত বিজ্ঞান।”
(চ) অর্থনীতিবিদ ওয়াকারের মতে, “অর্থনীতি একটি ধন সম্পর্কিত বিজ্ঞান।” তাঁদের মতামত দীর্ঘদিন যাবৎ অনুসরণ করা হয়। কিন্তু অর্থনীতিতে আলফ্রেড মার্শালের আবির্ভাবে পর এ মতবাদ -এর ছন্দপতন ঘটে এবং এর পরিবর্তে নিও- ক্লাসিক্যাল মতবাদের আবির্ভাব হয়।
২. নিও-ক্লাসিক্যাল মতবাদঃ নিও ক্ল্যাসিক্যাল মতবাদের প্রবক্তা হলেন আলফ্রেড মার্শাল। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত তাঁর “Principle of Economics” গ্রন্থে তিনি অর্থনৈতিক যে সংজ্ঞা প্রদান করেন তা ক্লাসিক্যাল মতবাদের পতন ঘটায়।
তাঁর মতে, “অর্থনীতি মানব জীবনের সাধারণ কার্যাবলি আলোচনা করে।” (“Economics is the study of mankind in
The ordinary business of Life”- A. Marshall.) মতবাদের গুরুত্বঃ মানবিক ও মানব কল্যাণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অনুসারিবৃন্দ: অর্থনীতির এ নিও-ক্লাসিক্যাল মতবাদের অনুসারিগণ ছিলেন-
১. আর ভিং ফিসার (Arving Fisher)
২. পিত্ত (Pigu).
৩. অধ্যাপক ক্যানন (Prof Connon),
৪. ডেভেন পোর্ট (Daven port).
৫. জে বি ক্লার্ক (J. B. clark).
তাঁদের মতে, “মানব কল্যাণ সাধন অর্থনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য এবং অর্থ উপার্জন ও ব্যয় সে উদ্দেশ্য সাধনের বাহনমাত্র।”
সময় কাল: উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের শেষ দিক হতে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত।
১.১৮৯০ খ্রীস্টাব্দে আলফ্রেড মার্শাল ‘Principle of Economes’ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ব্যষ্টিক অর্থনীতির উপরিউল্লিখিত প্রথম গ্রন্থ এটি। স্থায়িত্ব ও প্রচারের দিক থেকে এটি “Wealth of Nation” এবং “Principle of Political Economy” এর সমতুল্য। তাঁর মতে, “অর্থনীতি মানব জাতির দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে।”
২. ফিসারের মতে, “অর্থনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হল সম্পদের সাথে মানুষের জীবনের এবং কল্যাণের সংযোগ নির্দেশ কর।”
৩. অর্থনীতিবিদ পিণ্ড বলেন, “সামাজিক কল্যাণের যে অংশ প্রত্যক্ষভাবে অর্থের দ্বারা পরিমাপ করা যায় তার আলোচনা করাই অর্থনীতির কাজ।”
৪. নিও-ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণের মধ্যে মার্শালের সাথে আরও একটি নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য- তিনি হলেন জে. বি ক্লার্ক। তিনি আয় ও বণ্টন সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন। এই তত্ত্বটি, “বণ্টনের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতার তত্ত্ব নামে পরিচিত। নিও-ক্লাসিক্যাল মতবাদে সম্পদ আহরণের চেয়ে কল্যাণের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তাঁদের মতবাদও দীর্ঘদিন যাবৎ অনুসৃত হতে থাকে। কিন্তু অধ্যাপক লায়নেল রবিন্সের আর্বিভাবে মধ্য দিয়ে এ মতবাদের ছন্দ পতন ঘটে এবং আধুনিক মতবাদের উন্মেষ ঘটে।
৩. আধুনিক মতবাদ (Modern Concept)। আধুনিক মতবাদের প্রবক্তা হলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লায়বেল রবিন্স (Lionel Robins)। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে তিনি অর্থনীতির উপর সংজ্ঞা প্রদান করেন তা নিও- ক্লাসিক্যাল মতবাদের অবসান ঘটায়।
তাঁর মতে, “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা মানুষের অভাব এবং বিকল্প ব্যবহার যোগ্য দুষ্প্রাপ্য উপকরণসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনকারী কার্যাবলি আলোচনা করে।” (Economics is a Sceince which studies Human behaviour
as a relationship between ends and scarce means which have alternative uses-Lionel Robins)
মতবাদের গুরুত্ব: সম্পদের অপ্রতুলতা (সীমাবদ্ধতা), সম্পদের বিকল্প ব্যবহার এবং অভাবের আপেক্ষিক গুরুত্বের
উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। অনুসারিবৃন্দ। আধুনিক কালের সকল অর্থনীতিবিদ তাঁর মতবাদে বিশ্বাসী। এদের মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হলেন :
১. জে, এম, কেইনস (1. M. Keynes)
২. স্টোনিয়ার এবং হেগ (Shonier and Hague).
৩. অধ্যাপক পল, এ সামুয়েলসন (Paul. A. Samuelson), সহ অনেক
৪. আধুনিক অর্থনীতিবিদ,
৫. অধ্যাপক উইকস্টাড,
৬. স্টীগলার
৭. সীটভস্কি,
৮. এরিখ রোল প্রমুখ।
সময়কাল: ১৯৩১ সাল থেকে চলছে এ মতবাদ।মতবাদ:
(ক) ক্যামব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক Lionel Robins ১৯৩১ সালে প্রকাশিত তাঁর, “An Essay on the nature and significance of Economie sceince” নামক গ্রন্থে আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত সংজ্ঞা প্রদান
করেন যা তাঁর নামানুসারে Robins এর সংজ্ঞা নামে পরিচিত। তাঁর মতে, অর্থনীতি হচ্ছে এমন একটি বিজ্ঞান যা মানুষের অসীম অভাব ও বিকল্প ব্যবহার যোগ্য সীমাবদ্ধ উপকরণসমূহের সাথে সমন্বয় সাধনকারি কার্যাবলি পর্যালোচনা করে।” (Economies is a science which studies human behaviour as a relationship between ends and searce means which have alternative uses-L… Roibbins). (খ) স্টোনিয়ার এবং হেগ (Stonier and Hague) বলেন, “অর্থনীতি মূলত দুষ্প্রাপ্যতা এবং দুষ্প্রাপ্যতা থেকে উদ্ভুত সমস্যা সমূহের পর্যালোচনা।”
(গ) অধ্যাপক Paul A. Samuelson এর মতে, “কিভাবে মানুষ অর্থ দ্বারা এবং অর্থ ছাড়া দুষ্প্রাপ্য সম্পদকে বিভিন্ন উৎপাদন কাজে নিয়োগের জন্য নির্বাচন করে এবং কিভাবে সমাজ জনগণ বর্তমান ও ভবিষ্যতে ভোগের আশায় বণ্টন করে তার আলোচনাই অর্থনীতির বিষয়বস্তু।”
(ঘ) ১৯৩৬ সালে আধুনিক অর্থশাস্ত্রের সর্বাধুনিক গ্রন্থ “The General Theory of Employment, Interest and Money” নামক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। জে এম কেইনস কর্তৃক প্রণীত এই গ্রন্থটি অর্থশাস্ত্রের সমষ্টিগত (Macro-Economics) আলোচনার ক্ষেত্রে নবযুগের সূচনা করে।
(৬) অর্থশাস্ত্রের সর্বাধুনিক সংজ্ঞা হল- “স্বল্প উপকরণের বিলিবণ্টন এবং কর্মসংস্থান ও আয়ের নির্ধারক বিষয়সমূহের আলোচনা।” (“Economics Can be briefly defined as the study of administration of scarce resources and of the determinants of employment and income”-Bober).
উপসংহার: উপরের আলোচনা হতে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, আধুনিক অর্থনীতি-বিদগণ তাঁদের নিজস্ব সংজ্ঞা দ্বারা অর্থনীতিকে একটি নিরপেক্ষ বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। অর্থনীতি কল্যাণ-অকল্যাণ, ভাল-মন্দ, উচিত- অনুচিত ইত্যাদি বিবেচনা করে না। এল, রবিন্স এবং তার অনুসারীদের মতে, অসীম অভাব, সম্পদের সীমাবদ্ধতা, সম্পদের বিকল্প ব্যবহার এবং অভাবের আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ধারণই অর্থনীতির বিষয়বস্তু। আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ এভাবে অর্থনীতির আওতাকে বিস্তৃত করে একে একটি বাস্তব ধর্মী এবং সার্বজনীন বিজ্ঞানে পরিণত করেছেন।