অথবা, ন্যায়দর্শনে শব্দ প্রমাণের স্বরূপ সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, ন্যায়দর্শন অনুসারে শব্দ প্রমাণের স্বরূপ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, নৈয়ায়িকদের মতে শব্দ প্রমাণের স্বরূপ কী?
অথবা, ন্যায়দর্শনে শব্দ প্রমাণের স্বরূপ বা প্রকৃতি কিরূপ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় দর্শনের আস্তিক স্কুলসমূহের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শন হিসেবে ন্যায়দর্শন স্বাধীন চিন্তা ও বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গৌতম। ন্যায়দর্শনের প্রধান আলোচ্যবিষয় হলো জ্ঞানতত্ত্ব এবং এর উপর ভিত্তি করেই ন্যায় দার্শনিকরা তাঁদের দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ন্যায়দর্শনে জ্ঞানকে দুটি ভাগে প্রকাশ করা হয়েছে। যথা : ১. ‘প্রমা’ বা যথার্থ জ্ঞান (Valid Knowledge) এবং ২. ‘অপ্রমা’ বা অযথার্থ জ্ঞান (Non- valid knowledge)। জ্ঞান লাভের যে প্রণালি তাকে প্রমাণ বলা হয়। নৈয়ায়িকদের মতে, প্রমাণ (Valid knowledge)
চার প্রকার। যথা : ১. প্রত্যক্ষ; ২. অনুমান; ৩. উপমান ও ৪. শব্দ।
নিম্নে প্রশ্নপত্রের আলোকে ন্যায় উপমান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
অনন্ম ভট্টের মতানুসারে শব্দ প্রমাণের স্বরূপ : অন্নম ভট্ট বলেন, ‘আপ্তবাক্যং শব্দঃ’ । আপ্তব্যক্তির বাক্যই শব্দ প্রমাণ। অনাপ্তব্যক্তির বাক্য শব্দ প্রমাণ নয়। ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও করুণাপাটব-এ চারটি দোষ থাকলে পুরুষকে অনাপ্ত বলা হয়। ভ্রম হলো যথাযথভাবে বস্তুকে না জানা কিংবা বিপরীতভাবে জানা। প্রমাদ হলো অসাবধানতা। বিপ্রলিপ্সা হলো শ্রোতাকে বঞ্চনা করার ইচ্ছা। করুণাপাটব হলো ইন্দ্রিয়ের দৌর্বল্য। কোন বিষয় না জেনে বললে কিংবা বিপরীতভাবে জেনে বললে বক্তা অনাপ্ত হয়। আবার বক্তা যথার্থভাবে বিষয়টি জানে, প্রমত্তও নয়, তথাপি অন্যকে প্রতারিত করার জন্য যদি বলে তাহলেও সে অনাপ্ত হয়। অন্নম ভট্ট বলেন, ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও করুণাপাটব-এ চারটি দোষ যার নাই তিনি আপ্ত। অন্যকথায়, যে ব্যক্তি যে বিষয়ের যথার্থ জ্ঞানবান তিনি যদি সেই বিষয়ের তত্ত্বপ্রকাশের জন্য যথার্থ বাক্য প্রয়োগ করেন তাহলে সেই ব্যক্তিকে আপ্ত বলা হয়। বক্তার দোষ বাক্যকে অপ্রমাণ করে ফেলে। যথার্থ বক্তাই আপ্ত হন। তাইতো আপ্ত ব্যক্তির বাক্যই শব্দ প্রমাণ। কোন প্রমাণের দ্বারা যদি প্রকৃত পদার্থের যথার্থজ্ঞান হয় এবং ঐ জ্ঞানবান ব্যক্তির যদি ইচ্ছা হয় যে, অন্যেরও ঐ পদার্থের যথার্থজ্ঞান হোক, তাহলে ঐ ইচ্ছার পর তার বাক্য-উচ্চারণজনক প্রযত্ন বা কৃতি হয়। অতঃপর যদি সে ঐ পদার্থকে বুঝাতে সক্ষম শব্দ উচ্চারণ করে তাহলে ঐ শব্দ শ্রোতার যথার্থ জ্ঞানের জনক হয়ে শব্দ প্রমাণ হয়। এ জন্যই অন্নয় ভট্ট বলেন, ‘আপ্তবাক্যং শব্দঃ’ । জ্ঞায়মান আপ্তবাক্যই শব্দ প্ৰমাণ।জ্ঞানের বিষয় অনুসারে শব্দ প্রমাণ দুই প্রকারের। যথা : ১. দৃষ্টার্থ ও ২. অদৃষ্টার্থ।
দৃষ্টাৰ্থ : ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে আপ্ত ব্যক্তির যে বচন তাই দৃষ্টার্থ শব্দ প্রমাণ। বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি, মুনি- ঋষি বা শাস্ত্রের বাক্য হলো দৃষ্টাৰ্থ শব্দ।
অদৃষ্টার্থ : প্রত্যক্ষযোগ্য নয় এমন কোন বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে আপ্ত ব্যক্তির যে বচন তাইঅদৃষ্টার্থ প্রমাণ। ঈশ্বর সম্বন্ধে বেদ, পাপপুণ্য সম্বন্ধে মহাপুরুষগণ যা বলেছেন তা অদৃষ্টার্থ শব্দ । অন্য একদিক থেকে শব্দকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: ১. লৌকক ও ২. বৈদিক।
লৌকক : সাধারণ বিশ্বস্ত ব্যক্তির যে বচন তা লৌকিক শব্দ প্রমাণ।
বৈদিক : বেদের যে বচন তা বৈদিক শব্দ প্রমাণ। বেদের বাক্য ঈশ্বরের বাক্য। কাজেই বৈদিক শব্দ অভ্রান্ত।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, নৈয়ায়িক জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনায় শব্দ প্রমাণ সম্পর্কে যে সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ করেছেন তা ভারতীয় দর্শনের এক অমূল্য সম্পদ। তাইতো ন্যায়দর্শনের
শব্দ প্রমাণ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।