অনুমান সম্পর্কে সাংখ্য দার্শনিকদের অভিমত ব্যাখ্যা কর।

অথবা, সাংখ্য মতে অনুমান কী? অনুমানের প্রকারভেদ সম্পর্কে সাংখ্যদের অভিমত ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সাংখ্য মতে অনুমানের শ্রেণিবিভাগ কর।
অথবা, সাংখ্য মতে অনুমানের শ্রেণিবিন্যাস কর।
অথবা, সাংখ্য মতে অনুমান কত প্রকার ও কী কী?
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভারতীয় দর্শনগুলোর মধ্যে সাংখ্য দর্শনই প্রাচীনতম। সাংখ্য দর্শনে জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে। জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনায় সাংখ্য দর্শনে তিনটি প্রমাণ স্বীকৃত হয়েছে। যথা : প্রত্যক্ষ (Perception), অনুমান (Inference) ও শব্দ (Testimony)। উপমান (Comparison), অর্থাপত্তি (Postulation), অনুপলব্ধি (Non-Cognition) প্রভৃতি অন্যান্য প্রমাণগুলো এ তিনটি প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত বলে সাংখ্য দার্শনিকগণ এদের স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করেন নি। নিম্নে অনুমান সম্পর্কে সাংখ্য মত আলোচনা করা হলো :
অনুমান (Inference) : কোন একটি বিষয়কে প্রত্যক্ষ করে সে প্রত্যক্ষের ভিত্তিতে সে বিষয়ের সাথে নিয়ত বা ব্যাপ্তি সম্বন্ধযুক্ত অন্য আর একটি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াকে অনুমান বলা হয়। যেমন- কোন একটি পর্বতে ধোঁয়া প্রত্যক্ষ করে যদি ধারণা করা হয় যে, ঐ পর্বতে অগ্নি বা আগুন আছে। তবে এ জ্ঞানকে অনুমানলব্ধ জ্ঞান বলা হবে।
অনুমানের ভিত্তি হলো নিয়ত সম্বন্ধ বা ব্যাপ্তি সম্বন্ধ। দুটি বস্তুর মধ্যে যদি নিয়ত সম্বন্ধ বা ব্যাপ্তি সম্বন্ধ দেখা যায়। তবে একটিকে প্রত্যক্ষ করে, অন্যটির অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় এবং এ জ্ঞানকে অনুমানলব্ধ জ্ঞান বলা হয়।
অনুমানের ভাগ : সাংখ্য দর্শন মতে, অনুমানকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
১. বীত এবং
২. অবীত।
১. বীত : সদর্থক সামান্য বাক্যকে অবলম্বন করে যে অনুমান গড়ে উঠে তাকে বীত অনুমান বলা হয়। যেমন- সকল ধুমবান বস্তুই অগ্নিমান। পবর্তটি ধুমবান, সুতরাং পর্বতটি অগ্নিমান। এ অনুমানটির ভিত্তি হলো সকল ধুমবান বস্তুই অগ্নিমান। এটি সদর্থক ব্যাপ্তি।
২. অবীত : নঞর্থক সামান্য বাক্যকে অবলম্বন করে যে অনুমান গড়ে উঠে তাকে অবীত অনুমান বলা হয়। যেমন- ‘শব্দ’ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, দেশ, কাল, মন বা আত্মা কারো বিশিষ্ট গুণ নয়। সুতরাং ‘শব্দ’ অবশিষ্ট দ্রব্য যে আকাশ তারই বিশিষ্ট গুণ। এ অনুমানটির ভিত্তি হলো ‘শব্দ’ স্ফিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, দেশ, কাল, মন ও আত্মার বিশিষ্ট গুণ নয়। এটাই নঞর্থক ব্যাপ্তি । ন্যায় বৈশেষিক দর্শনে যাকে ‘শেষবৎ’ অনুমান বলা হয়েছে তাই সাংখ্য দর্শনের অবীত অনুমান।
বীত অনুমানের ভাগ : বীত অনুমানকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : ক. পূর্ববৎ এবং খ. সামান্যতোদৃষ্ট।
ক. পূর্ববৎ : দুটি বস্তু বা ঘটনাকে যদি সব সময় একত্রে উপস্থিত থাকতে পূর্বে দেখা যায় এবং তার উপর ভিত্তি করে যদি কোন অনুমান গড়ে উঠে তবে সে অনুমানই পূর্ববৎ অনুমান। যেমন : পূর্বে বহুবার ধুম ও অগ্নিকে সহগামী দেখে বর্তমানে কোন পর্বতে ধুম দেখে যদি কেউ অনুমান করে যে, পর্বতটিতে অগ্নি আছে তবে সে অনুমানের নাম হবে পূর্ববৎ অনুমান ।
খ. সামান্যতোদৃষ্ট : যে অনুমান কার্যকরণ সম্বন্ধের উপর ভিত্তি না করে কেবল সাদৃশ্যের৷ উপর ভিত্তি করে, সে অনুমানই ‘সামান্যতোদৃষ্ট’ অনুমান। যেমন- আমরা দেখি, প্রত্যেক কার্যের কারণ আছে; ‘বুদ্ধি’ একটি কার্য। সুতরাং তারও কারণ থাকবে। তাই বুদ্ধির কারণ যে প্রকৃতি তার অস্তিত্বকে প্রত্যক্ষ করতে না পারলেও অনুমান করতে পারে। এখানে
অনুমানের ভিত্তি হলো অন্যান্য কার্যের সাথে সাদৃশ্য। ন্যায়দার্শনিকদের মতো সাংখ্য দার্শনিকগণও বলেছেন যে, প্রতিটি অনুমানে পাঁচটি অবয়ব বা তর্কবাক্য থাকবে। যথা :
১. প্রতিজ্ঞা, ২. হেতু, ৩. উদাহরণ, ৪. উপনয় ও ৫. নিগমন। যেমন-
১. পর্বতটি অগ্নিমান (প্রতিজ্ঞা),
২. কারণ এটি ধুমবান (হেতু),
৩. সকল ধুমবান বস্তুই অগ্নিমান (উদাহরণ),
৪. পর্বতটি ধুমবান (উপনয়) ও
৫. পর্বতটি অগ্নিমান (নিগমন)।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সাংখ্য জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনায় অনুমানের যে শ্রেণিবিভাগ করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কারণ ন্যায়দার্শনিকদের মতো সাংখ্য দার্শনিকগণও প্রতিটি অনুমানের পাঁচটি অবয়ব ব তর্কবাক্যের কথা স্বীকার করেছেন।