অধ্যাপক মার্শাল ও অধ্যাপক এল, রবিন্স-এর অর্থনীতির সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য কি?

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, অধ্যাপক মার্শাল ও অধ্যাপক এল, রবিল এর অর্থনীতির সংজ্ঞার মধ্যে তুলনা কর।

উত্তর:প্রারম্ভিক কথা: এ পর্যন্ত অর্থনীতির উপর যে সকল সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে অধ্যাপক মার্শাল ও অধ্যাপক এল, রবিন্স-এর সংজ্ঞা দু’টিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য।

অধ্যাপক মার্শাল-এর অর্থনীতির সংজ্ঞাঃ মার্শালের মতে, Economics is the study of Mankind in the ordinary business of life, অর্থাৎ, “অর্থনীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যকলাপ আলোচনা করে।” মার্শালের সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্য। অধ্যাপক মার্শালের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথাঃ

১. সামাজিক বিজ্ঞান: মার্শালের মতে, অর্থনীতি একটি সামাজিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি সমাজের মানুষের কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করে। এই কার্যকলাপের মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হলো মানব কল্যাণ সাধন করা।

২. বস্তুগত পণ্য: মার্শালের সংজ্ঞায় বস্তুগত পণ্যের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়। কারণ তিনি মনে করেন প্রয়োজনীয় বস্তু প্রাপ্তি ও ব্যবহারের মধ্যেই মানব কল্যাণ নিহিত।

৩. মানব কল্যাণঃ অধ্যাপক মার্শালের মতে, অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হল মানুষ, মানুষের কল্যাণ ও কল্যাণের লক্ষ্যে আয় উপার্জন ও তার যথাযথ ব্যয় সাধন। এক কথায় মানব কল্যাণই অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য।

৪. সাধারণ কার্যকলাপ ঃ মার্শালের মতে, অর্থনীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করে। অভাব পূরণের লক্ষ্যে মানুষ কীভাবে আয় করে এবং অর্জিত আয় কিভাবে ব্যয় করে তা দৈনন্দিন কার্যকলাপের অন্ত-র্ভুক্ত। অর্থনীতির সংজ্ঞায় অধ্যাপক মার্শাল এভাবেই গুরুত্ব অরোপ করেন। মার্শালের মতে অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের কল্যাণ সাধন করা।

অধ্যাপক এল, রবিন্সের অর্থনীতির সংজ্ঞা: অধ্যাপক এল, রবিন্স বলেন, “অর্থনীতি একটি বিজ্ঞান যা বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সাম্পদ এবং অসীম অভাবের সমন্বয় সাধনে মানুষের আচরণ আলোচনা করে।” অর্থাৎ (Economics is a science which studies human behaviour as a relationship between ends and scarce means which have alternative uses.”

অধ্যাপক এল, বরিন্সের সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্যঃ অর্থনীতির কাঠামো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অধ্যাপক এল, রবিন্সের সংজ্ঞাটি মানব জীবনে তিনটি বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়। তা নিম্নে আলোচনা করা হলো: ১. অসীম অভাবঃ এল, রবিন্সের সংজ্ঞার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অসীম অভাব। অভাবের কোন শেষ নেই। একটি

অভাব পূরণ করলে আরেকটি নতুন অভাব দেখা দেয়। ফলে সীমিত সম্পদ ছাড়া অসীম অভাব পূরণ হয় না। এজন্য অসীম অভাব পূরণের ক্ষেত্রেই মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বিরামহীনভাবে প্রচেষ্টা চালায়।

২. সীমিত সম্পদঃ রবিন্সের সংজ্ঞায় সম্পদ সীমিত। তাই সীমিত সম্পদের কারণে অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এজন্য মানুষ যা করতে চায় তা অনেক সময় পারে না। যদি অভাবের মতো সম্পদ হতো তাহলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি হত না। মানুষ তার অভাব পূরণের ক্ষেত্রে সীমিত সম্পদ দিয়ে প্রতিদিন অফুরন্ত পরিশ্রম করে থাকে।

৩. সম্পদের বিকল্প ব্যবহার: সম্পদের যোগান সীমাবদ্ধ হলেও সে সম্পদকে বিকল্পভাবে ব্যবহার করা যায়। একখন্ড জমিতে ধান ও পাট উভয় উৎপাদন করা যায় তবে একই জমিতে একসাথে ধান ও পাট চাষ করা যাবে না।

এজন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে অভাব পূরণের ক্ষেত্রে কোনটি চাষ গ্রহণযোগ্য হবে। উল্লেখ যে, নির্দিষ্ট সময়ে একটি সম্পদ একাধিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় না।

অধ্যাপক মার্শাল ও এল রবিন্স এর মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য তুলে ধরা হলোঃ অধ্যাপক মার্শাল ও অধ্যাপক রবিন্স নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতির সংজ্ঞা প্রদান করার চেষ্ট করেন।

অধ্যাপক মার্শাল বলেন, “অর্থনীতি এমন একটি বিষয় যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে।” অন্যদিকে, অধ্যাপক রবিনসের মতে, “অর্থনীতি হচ্ছে এমন একটি বিজ্ঞান যা মানুষের অসীম অভাব ও বিকল্প ব্যাবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মানবীয় আচরণ বিশ্লেষণ করে।”

মার্শাল ও রবিনস প্রদত্ত উল্লিখিত সংজ্ঞা দুটির মধ্যে কোনটি অধিক গ্রহণযোগ্য সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। উভয় সংজ্ঞার তুলনামূলক আলোচনা করা প্রয়োজন।

১. মার্শালের সংজ্ঞায় মানব কল্যাণের উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। তিনি মনে করেন, “মানুষের সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলে রয়েছে মানব কল্যাণ। কিন্তু রবিনসের সংজ্ঞায় মানব কল্যাণের বিষয়টিকে উপেক্ষা করে মানব জীসনের বাস্তব দিক অসীম অভাব ও বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয়।”

২. মার্শাল তার সংজ্ঞায় বস্তুগত কল্যাণের কথা বলেছেন। কিন্তু রবিনসের সংজ্ঞায় বস্তুগত কল্যাণ ছাড়াও অবস্তুগত কল্যাণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি মনে করেন, “সেবার মাধ্যমেও মানব কল্যাণ সাধিত হতে পারে। যা মার্শালের সংজ্ঞায় উপেক্ষিত হয়েছে।”

৩. মার্শাল অর্থনীতিকে সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি তার সংজ্ঞায় বলেন, “সমাজবদ্ধ মানুষই অর্থনীতির আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু রবিনসের সংজ্ঞায় সমাজ বহির্ভূত মানুষের আলোচনাও স্থান পায়।”

৪. মার্শালের সংজ্ঞায় ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন তুলে অর্থনীতিকে নেতিবাচক বিজ্ঞানে রূপ দেন। কিন্তু
রবিনস তার সংজ্ঞায় নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন বাদ দিয়ে অর্থনীতিকে একটি নিরপেক্ষ বিজ্ঞানে পরিণত করেন।

৫. মার্শাল সম্পদের সাথে কল্যাণের বিষয়টি জড়িত করেন। কিন্তু সম্পদের অপ্রাচুর্যতার বিষয়ে কোন কথা বলেন নি। অন্যদিকে, রবিনসের সংজ্ঞায় সম্পদের অপ্রাচুর্যতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। যা প্রত্যেক অর্থনৈতিক সমাজের একটি অন্যতম মৌলিক সমস্যা।

৬. মার্শালের সংজ্ঞায় সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রবিনসের সংজ্ঞায় বিকল্প ব্যবাহরযোগ্য সীমিত সম্পদ বণ্টনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

৭. মার্শালের সংজ্ঞায় মানব কল্যাণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কল্যাণ একটি মনস্তাত্ত্বি ধারণা। মার্শাল তাঁর সংজ্ঞায় কল্যাণ ধারণাটি ব্যবহার করায় অর্থনীতির বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে রবিনস তাঁর সংজ্ঞায় মনস্তাত্ত্বিক ধারণাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অর্থনীতিকে বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানে পরিণত করেছে।

৮. রবিনস তাঁর সংজ্ঞায় ‘স্বল্পতার সমস্যা’ তুলে ধরে অর্থনীতিকে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছেন। অন্যদিকে মার্শাল অর্থনীতিতে কল্যাণ ধারণাটি ব্যবহার করে অর্থনীতির পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত করেছেন।

উপসংহারঃ উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, মার্শালের সংজ্ঞার তুলনায় রবিনসের সংজ্ঞায় মানব জীবনের মৌলিক ও বাস্তবিক দিক ফুটে উঠে। রবিনসের সংজ্ঞায় মানুষের অসীম অভাব ও বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রচেষ্টা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ মার্শালের সংজ্ঞার চেয়ে রবিনসের সংজ্ঞা অধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন।